এ এইচ সবুজ: [২] ইংরেজী সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেও কোন সরকারি অথবা বেসরকারী চাকরি মেলেনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মুকলেসের । অতীকষ্টের শিক্ষাজীবন শেষ করেও এখন চায়ের দোকানই মুকলেসের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। ওই দোকান করেই অতিকষ্টে চালাচ্ছেন তার তিন সদস্যের পরিবার।
[৩] গাজীপুর মহানগরের চতর নয়াপাড়া এলাকায় তার চায়ের দোকান। একই এলাকার নাগাতে ভাড়াবাড়িতে থেকে তিনি এই দোকান চালান।
[৪] প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, ২০১১ সালে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে তিনি কৃতিত্বের (সিজিপিএ ৩.০৫) সঙ্গে মাস্ট্রার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর থেকে বিসিএসসহ সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও কোন চাকরি পাননি। এখন মনে হচ্ছে এত কষ্ট করে পড়ালেখা করেও আমার শিক্ষা আমার, আমার পরিবারের অথবা দেশ ও দেশের মানুষের কোন কাজে লাগলো না। জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি সময় অনর্থক লেখাপড়া করে সময় নষ্ট করলাম। চায়ের দোকন করতে তো আর এতো লেখাপড়ার দরকার নেই। চাইলে অনেক আগেই তা করতে পারতেন বলে তিনি বলেন।
[৫] দরিদ্র বাবা মুনসুর ও মা রাশিদা বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ তিনি। জন্মের আড়াই বছরের মাথায় অজ্ঞাত রোগে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান। তারপরও তিনি হার মানেননি, অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে ২০০৩ সালে গাজীপুর বিওএফ হাইস্কুল থেকে এস.এস.সি ও ২০০৫ সালে গাজীপুর ক্যান্টনম্যান্ট কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় উত্তির্ন হন। ইচ্ছা ছিল শিক্ষা দিয়েই জীবনের সমস্ত প্রতিকুলতাকে জয় করে বিজয়ী হবেন। শিক্ষার খরচ যোগানোর জন্য তিনি এক সময় বাসযাত্রীদের কাছে নিজের লেখা বই, চকলেট বিক্রি করেছেন। অনেক পরিশ্রম , অধ্যবসায় ও ত্যাগ তিতিক্ষার পর শিক্ষা জীবন সফলতার সাথে শেষ করলেও কর্মজীবনের তিনি স্বার্থক হতে পারেননি।
[৬] এম এ পাসের পর সরকারী চাকুরী না পেয়ে তিনি মাত্র দুই হাজার টাকা বেতনে ঢাকার উত্তরায় কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। কলেজ কতৃপক্ষ এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন তারা তাদের কলেজে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষক আর রাখবেন না। ফলে তাকে শিক্ষকতা ছাড়তে হয়। ইতোমধ্যে তিনি বিয়ে করেছেন। স্ত্রী নাজনীন আহমেদও শারীরিক প্রতিবন্ধী । তাদের এক পুত্র সন্তান রয়েছে। এ অবস্থায় আর কোথাও কোন চাকরী না পেয়ে তিনি তার বাবার কাছে চলে আসেন, কিন্তু দরিদ্র ব্যবসায়ী বাবা তাকে ও তার পরিবারকে প্রতিপালনে অক্ষমতা প্রকাশ করেন।
[৭] এ অবস্থায় তিনি শৈশবের বন্ধু বান্ধব ও স্থানীয়দের সহযোগীতায় কয়েকটি এনজিও থেকে ঋন নিয়ে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও বিকাশ ফ্ল্যাক্সি লোডের দোকান দেন। পার্শ্ববর্তী একটি বাড়ির একটি টিনসেড ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এর কয়েকদিন পরেই দেশে প্রথম লকডাউন শুরু হয়। দোকান পাট বন্ধ রেখে সংসার চালাতে গিয়ে তিনি দোকানের মূলধন হারিয়ে ফেলেন। এরপরও তিনি মনোবল হারাননি । এঅবস্থায় অনেকটা বাধ্য হয়েই চায়ের দোকান দিতে বাধ্য হন। এ কাজে তার স্ত্রী তাকে সহযোগীতা করেন। এছাড়া কিছু জমির ব্যবস্থা করতে পারলে পোল্ট্রী, ছাগল অথবা মাছের খামার করে নিজের ভাগ্য উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন। ইতোমধ্যেই সরকারী খাসজমি বরাদ্দের জন্য তিনি গাজীপুর জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছেন। জমি পাওয়া গেলে তিনি খামার করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করবেন।
[৮] বর্তমানে করোনার দীর্ঘ লকডাউনে ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তিনি ঋনগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। দৈনিক, সাপ্তাহিকসহ কয়েকটি এনজিওর কিস্তি চালাতেই তার কষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থায় পরিবার চালাবেন কি দিয়ে। তিনি সমাজের বৃত্তবান ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের কাছে সহযোগীতা চান। তার সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর -০১৯১৭৬৬২৫৪৮ ।
[৯] মুকলেস জানান, পড়ালেখা শেষ করে তিনি শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করলেও তার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির সুযোগ না থাকায় তার শিক্ষাজীবনটাই অনর্থক হয়ে গেছে। চায়ের দোকান করতে তো শিক্ষিত হতে হয় না। সরকারী চাকুরীতে প্রতিবন্ধী কোটা থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও তার চাকরি হয়নি। সরকারি প্রতিবন্ধী কোটার ক্ষেত্রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কি সুযোগ দেওয়া হবে। তার কাজের ধরন কি হবে । সে বিষয়ে স্পষ্ট কোন দিক নির্দেশনা নেই। তিনি ১০ম কলেজ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে উত্তির্ণ হন। কিন্তু অজ্ঞাত কারনে এ অবধি তার কোন চাকরি হয়নি। বর্তমানে সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় সেদিকে আরা কান সম্ভাবনা নেই। তাই স্বাবলম্বী ও স্ব-কর্মসংস্থান ছাড়া অন্য কোন উপায়ও নেই।
[১০] গাজীপুর শহর সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক মজুমদার জানান, একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া বাস্তবিকই অনেকটা অধ্যবসায়ের বিষয়। সরকারি ও বেসরকারি চাকরি ক্ষেত্রে কোন সুযোগ না পাওয়াটাও দুঃখজনক। প্রতিবন্ধী নাগরীকদের পূনর্বাসন ও স্বাবলম্বী করে তুলতে আমরা কাজ করি। আমাদের সমাজসেবা বিভাগ থেকে তাদের মাসিক ভাতার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া প্রতিবন্ধী নাগরিকদের ব্যবসা বানিজ্যের সুবিধার জন্য আমরা ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করে থাকি। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা অবশ্যই তাকে সহযোগীতার চেষ্টা করবো।