ড. আহমদ আল কবির
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নেতৃত্বে যারা ছিলেন জেলহত্যা দিবসে তাদের সকলের ওপরই আঘাত আসে। সেই নেতাদের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এম কামরুজ্জামান। তারাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পুরো স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিচালনাকারীদের মূল কেন্দ্রবিন্দু। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকা পরে তারা ভাবে এই কয়েকজন জাতীয় নেতাকে যদি শেষ করে দেওয়া যায় তাহলে যারা স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলে তা আর দীর্ঘায়িত হবে না।
কারণ ওই সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল থেকে কথাও হচ্ছিলো কীভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি কনফেডারেশন করা যায়।
১৯৮৫-১৯৮৬ সালেও দেখেছি পাকিস্তানে একটি বড় গ্রপ এই নিয়ে কাজ করছে। তারা জিজ্ঞেস করতো পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন হবে কিনা? পাকিস্তানের করাচিতে মাহমুদ আলী, গোলাম আযমের ভাই ছিলো। তারা ওইভাবে চিন্তা করতো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে তারা এই চিন্তা নিয়েই এগোতে থাকে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হেনরি কিসিঞ্জার পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দারুণভাবে ব্যস্ত ছিলো। তিনি চাচ্ছিলেন যেকোনো ভাবে এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবে। আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় কুচক্রীরা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে এই হত্যাকা ঘটায়। এর খলনায়ক ছিলো খুনি মোশতাক। তার সঙ্গে বিপদগামী সেনা সদস্যরা ছিলো। তারা এই ঘটনাটি ঘটায়। কিন্তু বুদ্ধি এসেছে মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ভেতর এবং বাইর থেকে স্বাধীনতাবিরোধীর কাছ থেকে। এই প্রেক্ষাপট না জানলে জেলহত্যা কেন ঘটলো সেটা বোঝা যাবে না।
তারা ভেবেছে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যরা নিহত হয়েছেন, এখন যদি চার নেতাকে হত্যা করা যায় তাহলে আওয়ামী লীগের কাঠামো দখল করা যাবে। দখল করা তারা যেই পবির্তন চাচ্ছিলো সেটা তার করতে পারবে। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা দেখিছি তারা চেষ্টাও করেছে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগকে দখল করার। যখন দেখলো যে আওয়ামী লীগকে দখল করা যাচ্ছে না তখনই তারা সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে অন্য পন্থাতে যায়। তারা রাজনীতিতে আসার চিন্তা করে। সেই হিসেবে জাগো দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক মোর্চা করে। সামরিক পোশাকে একদিকে কমান্ডারিং চিফ অন্যদিকে রাজনৈতিক দল পরিচালনা করে এবং এর পরে হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে মানুষের ভোটের রাজনীতি ও সত্যিকারের গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করে তারা তাদের পুরো চক্রান্তটিকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছিলো। এক্ষেত্রে তারা অনেকটা সফলও হয়েছিলো। সামরিক এবং বেসামরিক লেবাসে প্রায় ২১ বছর তারা দেশ শাসন করেছে। জিয়াউর রহমানের আমল, পরবর্তী পর্যায়ে এরশাদের আমলের পুরো সময়টি সামরিক এবং বেসামরিক লেবাসে তারা দেশ শাসন করেছে। ওই সময় দেশে স্বাধীনতাবিরোধী যারা ছিলো, তাদের নেতৃত্বে ছিলো শাহ আজিজ। তাদের সেসময় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য মন্ত্রী বানানো হয় এবং বিভিন্ন দূতাভাসে খুনিদের পদায়ন করা হয়। তাদের পুনবার্সনের প্রক্রিয়াও ছিলো এর ধারাবাহিকতার একটি ফসল।
দীর্ঘদিন পর এই অবস্থার পবির্তন এসেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের পুনর্ঘটনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থানকে সুদৃৃঢ় করার যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে, এটা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের মতো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আমরা দেখেছি ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা এবং বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেশে প্রথম কৃষি বিপ্লব ঘটানো হয়। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষিত করে বিদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া, শ্রমবাজারকে বিশ^বাজারে খুলে দেওয়া, কৃষি ছাড়াও বিভিন্ন খাতগুলোকে আরও সম্প্রসারিত করা, অর্থনীতির মূল খাতগুলোকে সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো হয়। যেটা ৫ শতাংশে থেমে গিয়েছিলো। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর সময়ে স্বাধীনতার প্রথমদিকে এটা ৮-৯ শতাংশে ছিলো। এর পরে আবার ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশের প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নেওয়ার যে পরিকল্পনা নেন এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ভিশন ২০২১ ও ভিশন ২০৪১ এর মাধ্যমে যে কর্মসূচি নেওয়া হয় এর ফলশ্রতিতে দেশ আজ একটা ভিন্ন অবস্থানে চলে গেছে।
এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্বাধীনতা বিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের বাধাকে অনেক খাটো করে দিয়েছে। মানুষ এখন বুঝতে পারে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে ও জনগণের ক্ষমতায়ন করে যেই কাজটি হয়েছে সেটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৩ নভেম্বরের মর্মান্তি¡ক ঘটনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে ওই সময়ে সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পরবর্তী ২১ বছর এই ক্ষতির কারণেই পুরো জাতিকে মূল্য দিতে হয়েছে। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কারণেই এখন আবার বাঙালি জাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। বিশে^র কাছে এখন আমরা একটি মিরাকেল ও উদাহরণ আকারে আভিভর্‚ত হয়েছি। আমরা এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই। বিশে^র কাছে এখন আমরা উন্নয়নের একটি রোল মডেল। এটি জাতিসংঘও বলছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল উন্নত রাষ্ট্র আমাদের বলছে ২০২৬ সালে আমাদের জিডিপির আকার ৫০০ বিলিয়ন ডলারের ক্লাবে চলে যাবে। এই অবস্থানকে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। স্বাধীনতা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, যারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্ত অবস্থান নিতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম, যুব সমাজকে এই বিষয়গুলো অনুধাবন করতে হবে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। আজকের দিনটিতে আমার এই প্রত্যাশা থাকবে। এটিই হবে আমাদের সত্যিকারের সম্মান প্রদর্শন করা যেসব জাতীয় নেতাকে আমরা হারিয়েছি তাদের প্রতি, আমাদের জাতির পিতার প্রতি, তার পরিবারের প্রতি।
জাতীয় চার নেতার হত্যাকা বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা আছে। যাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে তারাও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। তাদের দেশে ফেরত আনা অনেক কঠিন। তবে এই কাজটি সরকার বিবেচনা করে বিভিন্নভাবে কাজ করছে। দীর্ঘদিন এই বিচারকার্যক্রম পড়ে ছিলো। এই বিচারকেও তারা বাধাগ্রস্ত করেছিলো সামরিক এবং বেসামরিক পোশাকে এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলো তারা। এই চক্রান্তটি অনেক বড় ছিলো। জাতির জন্য এটি একটি ভালো দিক যে আমরা এই চক্রান্তের বেড়াজাল থেকে বের হতে পেরেছি। যারা এখনো দেশে ফিরে আসেনি তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের অনেকেই দারুণভাবে হাইডআউটে আছে যাদের দেশে ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন। যেহেতু আমাদের রায় হয়েছে অনেককে
শাস্তি দেওয়া হয়েছে। অনেক দেশ মৃত্যুদ শাস্তি দেওয়ার পরে কোনো মানুষকে হ্যান্ডওভার করতে চায় না তাদের স্থানীয় আইনের কিছু বেড়াজাল থাকার জন্য। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। আমরা যেভাবে দেশকে গড়ে তুলছি সেভাবে এগুলোকে ওভারকাম করবো বলে আমার বিশস।
পরিচিতি : সাবেক চেয়ারম্যান, রূপালী ব্যাংক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমিরুল ইসলাম