এ এইচ সবুজ: [২] কোনোটি মোটা আবার কোনোটি সরু অবস্থায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নিষ্প্রাণ গাছে প্রাণ দেওয়ার তীব্র প্রয়াসে গাছের গায়ে আঁকা হয়েছে ভিন্ন সব কারুকাজ। প্রায় নগ্ন গাছগুলোকে যেন নতুন জামা পরানো হয়েছে। প্রতিটি কাণ্ডে নতুনকুঁড়ি-পাতার দেখাও মিলছে। মানুষ বৃক্ষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে আবার বৃক্ষই মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখছে। যেন সৃষ্টির গোপণ রহস্য সহজেই মেলে ধরা হয়েছে চিত্রগুলোতে।
[৩] সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা পরিষদ চত্বরে প্রায় শতাধিক ছোট-বড়, মোটা-সরু গাছে করা হয়েছে চিত্রকর্ম। উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. শিবলী সাদিকের উদ্যোগে করা চিত্রকর্মগুলো ইতোমধ্যে স্থানীয়দের নজর কেড়েছে। চিত্রকর্মে বলা হচ্ছে হাজারো গল্প। আর এ গল্প মানুষের, প্রকৃতির ও দেশের। চিত্রশিল্পী আহসান হাবীব সাজুর আঁকা রঙ-তুলির খেলা এখন উপজেলার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এমন চিত্রকর্মে বিমোহিত হচ্ছে সাধারণ মানুষও।
[৪] গাছের গায়ে আল্পনা আঁকতে চিত্রশিল্পী আহসান হাবীব সাজুকে এ কাজে সহযোগিতা করেন স্থানীয় আরেক চিত্রশিল্পী উপজেলার দড়িসোম গ্রামের আয়নাল হোসেন। প্রকৃতির প্রেমে পড়ে থাকা একজন শিল্পীই কেবল এমন ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে পারেন, তার প্রমাণ সাজুর চিত্রকর্ম।
[৫] উপজেলার পরিষদের বাসিন্দা ও সমবায় অফিসে কর্মরত আসাদুজ্জামান এরশাদ বলেন, ‘পুরো উপজেলাকে যেন রঙিন সাজে সাজানো হয়েছে। দেখতে খুব ভালো লাগছে। সারাদিন কাজ করার পর মনে ক্লান্তি থাকলেও গাছের চিত্রকর্মগুলো দেখলে এক নিমিশেই মন ভালো হয়ে যায়।
উপজেলা পরিষদের আরেক বাসিন্দা শিক্ষক শাহানাজ আক্তার বলেন, ‘আসলে গাছের গায়ে রঙ-তুলির আঁচড় উপজেলা পরিষদকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। দেখলেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।’
[৬] উপজেলা সমাজসেবা অফিসে সেবা নিতে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তফা মিয়া বলেন, ‘বয়স হয়েছে, তারপরও নানা রঙ-বেরঙের খেলা দেখলে সেই শৈশব-কৈশোরে ফিরে যাই। আমাদের ইউএনও সাহেব স্ব-উদ্যোগে নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে কাজটি করেছেন। খুবই ভালো লাগছে।’
[৭] স্থানীয় চিত্রশিল্পী আয়নাল হোসেন জানান, কালীগঞ্জে তার একটি আর্টের দোকান রয়েছে। নানা ধরনের সাইনবোর্ড বা দেয়াল লেখার কাজ করেন তিনি। কিন্তু এ কাজটিতে সহযোগিতা করে তিনি খুবই মজা পেয়েছেন। কারণ এই ধরনের কাজ এর আগে তিনি কখনো করেননি। গাছের গায়ে চিত্রকর্ম করার পর খুবই ভালো লাগছে। তবে কাজের বা রোজগারের জন্য নয়, এ কাজ করে তার মনে হয়েছে প্রকৃতির জন্য কিছু করেছেন।
[৮] উপজেলা পরিষদ জুড়ে গাছের গায়ে আল্পনা আঁকা চিত্রশিল্পী আহসান হাবীব সাজু জানান, প্রকৃতির সঙ্গে গাছ আর মানুষের যে সম্পর্ক, তা তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, বাঁচবে পাখি ও জীবন। সৃষ্টির প্রতিটি জীবন একে-অপরের সঙ্গে জড়িত।’
[৯] তিনি আরো জানান, ‘মানুষ যেমন একসময় বৃদ্ধ বয়সে এসে শেষ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি গাছগুলোও তাই। সে রেখে যায় তার বংশধর বা নিদর্শন। মানুষও তাই। গাছের অনেক দুঃখ আছে। যেগুলো প্রকাশ করতে পারে না। রঙ-তুলির আঁচড়ে গাছের গায়ে কষ্টগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। মানুষেরও সেই রকম অনেক কষ্ট থাকে, অনেক কিছু সে প্রকাশ করতে পারে না।’
[১০] সাজু আরো জানান, ‘আমরা সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছে গেছি, কিন্তু শিক্ষার সেই বিবেককে এখনো জাগ্রত করতে পারি নাই। প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি গাছ আর পরিবেশ। গাছ ধ্বংসের ফলে পরিবেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আমি গাছের গায়ে রঙ দিয়ে গাছেরও জীবন-যৌবন আছে সেটা মনে করিয়ে দিয়েছি। আদি যুগে যেভাবে মানুষ হত্যা করা হতো, ঠিক সেইভাবে গাছকেও আজকাল হত্যা করা হচ্ছে।