নিউজ ডেস্ক: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর জীবনমান উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বিভিন্ন সরকারি সেবায় তাদের অন্তর্ভুক্তিতে বাধা ও বৈষম্যের পাশাপাশি এ নিয়ে জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)। কালের কণ্ঠ
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক সেবা নিশ্চিতে জবাবদিহির ব্যবস্থা শক্তিশালী করা না হলে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ‘কাউকে পেছনে না রাখা’ লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে। ‘সরকারি সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা : জবাবদিহি ব্যবস্থার বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বৃহস্পতিবার এ মন্তব্য করার পাশাপাশি সংকট উত্তরণে ১০ দফা সুপারিশ রাখে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা— নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট (কোয়ালিটেটিভ) মো. মোস্তফা কামাল এবং তত্ত্বাবধান করেন একই বিভাগের সিনিয়র ফেলো শাহজাদা এম আকরাম। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মন্জুর-ই-আলম। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যপূর্ণ আচরণ বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সম-অধিকারপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘দেশের উন্নয়ন এবং সরকারি সেবা ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত সুফলপ্রাপ্তি এবং এই বঞ্চনার প্রতিকারের জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও বিধি রয়েছে, তা ব্যবহারের সুযোগ থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে তাদের প্রান্তিকতা আরো প্রকটতর হচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের মূলমন্ত্র—কাউকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পেছনে রাখা যাবে না, সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ফলে সুদূরপরাহত হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের সংবিধানে যে সমতাভিত্তিক বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের অঙ্গীকার রয়েছে, সেটি পদদলিত হচ্ছে বলে আমরা মনে করি।’
সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি ও অস্পষ্টতা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্তীকরণে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, ‘সেবা প্রদানের জন্য এবং অভিযোগ দায়েরের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে, যেটি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ায় সেবা প্রাপ্তি থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হন। বঞ্চিত হওয়ার পর যদি অভিযোগ করেন, তখন তারা বাঁধাগ্রস্ত হন কিংবা প্রতিকার পান না। বরং অনেক সময় অভিযোগ উত্থাপন করলে হুমকির সম্মুখীন হন। ‘এ ক্ষেত্রে আমরা দুঃখজনকভাবে লক্ষ করেছি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাংশ মূলত প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে থাকে এবং তাদের মানসিকতাও অনেক সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে নেতিবাচক।’
সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণায়। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তিতে বাধা দূর করা এবং বৈষম্যহীন ও জবাবদিহিমূলক সেবা নিশ্চিত করতে বৈষম্য বিলোপ আইন দ্রুত প্রণয়ন করা; সব প্রান্তিক গোষ্ঠীর ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও নিয়মিত হালনাগাদ করা; সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা ও জবাবদিহি ব্যবস্থা সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে এবং সব গণমাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাষায় যথাযথ এবং নিয়মিত প্রচার পরিচালনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রচার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং সংশ্লিষ্ট বেসরকারি অংশীজনদের সম্পৃক্ত করা; সেবাসংক্রান্ত অভিযোগ কাঠামো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীবান্ধব করার জন্য সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী থেকে মৌখিক অভিযোগ গ্রহণ ও তা লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করা ও সমাধানে নিয়মিত ফলোআপ করা; সরকারি প্রতিষ্ঠানের গণশুনানিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যা নিয়ে আলাদা সময় বরাদ্দ এবং সমস্যা প্রকাশে উৎসাহিত করা।
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০২০ সালের অক্টোবর ও চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে গুণবাচক এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরিমাণবাচক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে আদিবাসী, এসিডসন্ত্রাসের শিকার, দলিত, চা-বাগান শ্রমিক, হিজড়া জনগোষ্ঠীদের অন্তর্ভুক্ত করে গবেষণাটি করা হয়। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য সুশাসনের নির্দেশক আইনি সক্ষমতা, জবাবদিহি, স্বছতা এবং অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফল বলছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উপাত্তের অনুপস্থিতি তাদের প্রতি উদাসীনতা ও অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ এবং তাদের মূলধারায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরকারি সেবা ও জবাবদিহি ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রচারে ঘাটতি বিদ্যমান।
গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশ সংবিধানে নাগরিকের বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যের কারণে অধিকার ও সেবা প্রাপ্তিতে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না উল্লেখ করা হলেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ‘খসড়া বৈষম্য বিলোপ আইন’ এখনো পাস হয়নি। আবার খসড়া আইনে অভিযোগ অনুসন্ধানকারী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে জবাবদিহি করার বিষয়টি উল্লেখ নেই। অন্যদিকে তদন্তের স্বার্থে ‘সময় বর্ধিত’ করা এবং ‘যুক্তিসংগত’ কারণে মামলা মুলতবির সুযোগ আইনে দেওয়া আছে, যার পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা খসড়া আইনে অনুপস্থিত। ফলে মামলা সম্পন্ন হতে দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ থাকে।