শাহাজাদা এমরান : তীব্র অভাবের সংসার। তাই নবম শ্রেণিতে পড়ার পর আর পড়া লেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বেছে নিলেন দর্জির কাজ। সেই থেকে শুরু। দেখতে দেখতে ছয় ছয়টি দশক পেরিয়ে গেলো। এরমধ্যে অর্ধশত বছর ধরেই কাজ করছেন এক জায়গায় ।
ষাট বছরের দর্জি জীবনের প্রাপ্তির কথা বলতে গিয়ে জীবন সায়াহ্ণে উপনীত হওয়া বস টেইলার্সের স্বত্বাধিকারী শান্তি টেইলার্স জানান,অভাব অনটনের সংসার বলে কথা।
খুব বেশি নতুন কাপড় পরা হয়নি। পরের নতুন কাপড় সেলাই করেই অনুভব করি নিজের শান্তি রঞ্জন দাস। ১৯৩২ সালে কুমিল্লা নগরীর ঠাকুরপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা স্বর্গীয় হরি চন্দ্র দাস এবং মাতা স্বর্গীয় অবলা সুন্দরী। পিতা মাতার দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে শান্তি রঞ্জন দ্বিতীয়। নানা আর্থিক অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠা শান্তি রঞ্জন দাস নবম শ্রেণিতে উঠার পর পড়াশুনায় আর বেশি দূর এগুতে পারেননি।
নগরীর ঠাকুরপাড়া রামচন্দ্র পাঠশালায় পড়াকালীন সময়েই যোগ দেন রানির বাজারের গুলজার টেইলার্সের দোকানে। আস্তে আস্তে শিখতে থাকেন কাপড় সেলাই থেকে শুরু করে কাপড় কাটা পর্যন্ত। মেধার সাথে চেষ্টা থাকায় অল্প সময়ের মধ্যেই দর্জির পুরো কাজ তার আয়ত্তে চলে আসে। কাজে পারদর্শী,ব্যবহার ভাল থাকায় নজরে পড়ে শহরের বাগিচাগাঁও নিবাসী সাবেক এমএনএ নুরুল ইসলাম খানের।
তিনি তখন বাগিচাগাঁও বড় জামে মসজিদের সেক্রেটারি ছিলেন। মসজিদের এক কোণে ছোট একটি কক্ষে সম্ভবত ১৯৬০ সালের দিকে বাগিচাগাগাঁও এলাকায় তার কর্মজীবন শুরু হয় যা এখনো চলছে । এক পর্যায়ে মসজিদটি ভেঙে পুন:নির্মাণ করলে দোকান ঘরটিও যায় ভেঙে। তখন অসহায় শান্তি রঞ্জন দাসের পাশে এসে আবারও দাঁড়ায় বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সাবেক এমএনএ নুরুল ইসলাম খান।
তিনি তার নিজের খাঁ বাড়ির দেয়াল ভেঙে শান্তি রঞ্জন দাসের জন্য একটি রুম করে দেন। সেই থেকে এই রুমটিই শান্তি দাসের বস টেইলার্সের দোকান ঘর। গত ৫০ বছর ধরে এই দোকানে তিনি দর্জির কাজ করলেও দোকান ভাড়া এমনকি বিদ্যুৎ বিলও কোনদিন দিতে হয়নি। সব কিছুই দেখভাল করে খান পরিবার।
নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে শান্তি রঞ্জন দাস বলেন,১৯৬১ সালে চিনু বালা দাসকে বিয়ে করি। আজ থেকে বারো বছর আগে আমার স্ত্রী মারা যায়। তিন মেয়ে ও দুই ছেলের সবাইকে মানুষ করেছি,বিয়ে দিয়েছি। সংসার টেনে টেনে আজ এ পর্যন্ত এনেছি।
সবই দর্জির কাজ করে। দর্জি ছাড়া জীবনে আর কিছুই শিখিনি। এখন আমার বয়স কাগজে কলমে ৮৮ বছর হলেও প্রকৃত বয়স ৮৯ বছর হবে। ভগবানের দোয়ায় এখনো আমি সকাল ১০ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত দর্জির কাজ করি। আমার বাসা শহরের রাজগঞ্জে। প্রতিদিন বাসা থেকে দোকান আবার দোকান থেকে বাসা দুই বার হেঁটে যাই এবং হেঁটে আসি। পারতপক্ষে কোনদিন রিকশায় উঠি না। এ জন্যই ভগবান আমাকে ভাল রেখেছে।
অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে দর্জি কাজ করে। আমি আমার এই জীবনে এমপি,ডিসি,এডিসি থেকে শুরু করে রিকশা চালকের কাপড়ও সেলাই করেছি। জামা, প্যান্ট,পেটিকোট ব্লাউজ তৈরি করে দিয়েছি।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে তখন এরশাদ সরকার ক্ষমতায় ছিলেন। তখন কুমিল্লার একজন এডিসি ছিলেন। নাম আবদুল কুদ্দুছ। আমি নিয়মিত তার ও পরিবারের সকল কাপড় সেলাই করে দিতাম। তিনি আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে রাজগঞ্জে একটি খাস জায়গা লিজ দেন। যেখানে এখন আমি ছেলেদের নিয়ে থাকি।
যখন এই পেশায় কাজ শুরু করেছেন তখনকার সময়ের সাথে বর্তমান সময়ের পার্থক্য জানতে চাইলে শান্তি রঞ্জন দাস বলেন, তখনকার সময়ের ছেলেরা অনেক সম্মান করত।আদব কায়দা ছিল। এখনকার ছেলেদের মধ্যে আগের মতো আদব কায়দা দেখি না। এটাই আমার কাছে বড় পার্থক্য।
টেইলার্স হিসেবে ৫৫ বছরের বর্ণাঢ্য তিক্ত মধুর অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে শান্তি রঞ্জন বলেন,অভাব অনটনের সংসারে বড় হয়েছি। অল্প বয়সেই সংসারের দায়িত্ব নিয়েছি। তাই নিজে কখনো খুব একটা ভাল কাপড় পরতে পারিনি।
তবে অনেক দামিদামি কাপড় আমি অন্যের জন্য সেলাই করেছি। নিজে না পরতে পারলেও অন্যের কাপড় সেলাই করেই আমি সুখ অনুভব করি। কারণ, এই সুঁই সুতা দিয়েই আমি আমার স্ত্রী, সন্তানদের ভরণপোষণ করেছি, প্রশাসন থেকে মাথাগোঁজার ঠাঁই পেয়েছি।
তবে তিনি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান,বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানের পিতা ও সাবেক এম এন এ নুরুল ইসলাম খান, তার স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি। এই খান পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া তিনি আজ এ পর্যায়ে আসতে পারতেন না বলে জানান।
৮৮ বছর বয়সেও কাজ করতে কোন সমস্যা হয় কি-না জানতে চাইলে বয়সের ভারে ন্যূব্জ শান্তি রঞ্জন দাস বলেন, আগের থেকে কাজ অনেক কম। এখন তো বড় বড় মার্কেট হয়েছে, বড় বড় বিলাস বহুল টেইলার্সের দোকান হয়েছে।
বর্তমান প্রজেন্মর ছেলেরা আমার এখানে এখন আর আসে না। তবে আমার বাগিচাগাঁও এলাকার মুরুব্বিরা এখনো আমাকে দিয়ে কাজ করায়। দৈনিক গড়ে আমি তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকার কাজ করি। এখনতো ছেলেরাও কাজ করে। সারাজীবন দর্জির কাজ করছি। এখন আর অবসর থাকতে পারি না।
ভগবানের কাছে আমার একটাই চাওয়া,আমি যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দর্জির কাজটি করে যেতে পারি। এটাই আমার পরম আনন্দ। সম্পাদনা: জেরিন আহমেদ