মুহাম্মদ মিজানুর রহমান: আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে অসংখ্য নিয়ামত দিয়ে ভরে দিয়েছেন। বিনিময়ে তিনি চেয়েছেন মানুষের আনুগত্য। যে আনুগত্যের কারণে বান্দা তার নিজেরই কল্যাণ সাধন করে। যদি পৃথিবীর সব মানুষ তাঁকে ভুলে যায়, তাতেও আল্লাহর কোনো অসুবিধে হবে না। কারণ তার তাসবিহ পড়ার মতো মাখলুকের অভাব নেই। তিনি ইচ্ছা করলে মানবজাতিকে বাদ দিয়ে এর স্থলে অন্য কাউকেও স্থলাভিসিক্ত করতে পারেন। যারা তাঁর কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য প্রকাশ করবে।
আল্লাহতায়ালা মানুষকে অগণিত নেয়ামত দান করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সময়। মুমিন জীবনে যার গুরুত্ব সবথেকে বেশি। তাই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,‘সময়ের কসম, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তবে ঐ সমস্ত লোকগুলো ব্যতীত যারা ইমান এনেছে, নেক কাজ করেছে, একে অপরকে ভালো কাজের তাগিদ দিয়েছে আর দিয়েছে ধৈর্য ধারণের উপদেশ।’ (সূরা আল আসর, আয়াত : ০১-০৩)।
পবিত্র কোরআনের অসংখ্য জায়গায় আল্লাহতায়ালা এভাবে সময়ের কসম খেয়েছেন। কোথাও দিবারাত্রির কথা বলেছেন। কোথাও বলেছেন দিনের। আবার কোথাও রাতের। উদ্দেশ্য একটাই মানুষকে সময়ের গুরুত্ব বোঝানো। মানুষ একটু পর্যবেক্ষণ করলেই দেখতে পাবে, শরিয়তের প্রতিটি বিধান সময়ের সাথে সম্পর্কিত। তাই সেটা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত বা অন্য যা কিছু হোক না কেন। তাই পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে,‘...নিশ্চয়ই নামাজ ইমানদারদের উপর সুনির্দিষ্ট সময়ের সাথে ফরজ করা হয়েছে। (সূরা আন নেসা, আয়াত-১০৩)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে তিনি বলেন,‘আমি রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন আমল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়? তিনি বললেন, যথা সময়ে নামাজ আদায়।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
মানব জীবনের সময় এক মূল্যবাদ সম্পদ। দিনে শেষে রাত আসে আর রাতের শেষে দিন। এবারেই বয়ে চলে সময়ের গতি। এই স্রোতধারায় বয়ে চলা মানুষের জীবনও। এক সময় তা ফুরিয়ে যায়। জীবন খাতায় জমা হতে থাকে হিসেবের এক দীর্ঘ ফিরিস্তি। কারণ এই মূল্যবান সময়ের প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব মানুষকে দিতে হবে। অন্যথায় কেয়ামতের ময়দান থেকে সে এক কদমও নড়তে পারবে না। তাই মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত জীবনকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। প্রতিটি মুহূর্তকে সত্য-সুন্দর ও হকের পথে ব্যয় করে জান্নাত হাসিল করে নিতে হবে। তবেই জীবনের সফলতা। হজরত মা’আয ইবন জাবাল (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন,‘কিয়ামতের দিন চারটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো বান্দার পদ যুগল এক বিন্দু পরিমাণ নাড়াতে পারবে না। যার প্রথম প্রশ্নটি হবে তার জীবন সম্পর্কে। ব্যক্তি দুনিয়ায় তার জীবন কিভাবে ব্যয় করেছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন তার যৌবন সম্পর্কে। সে তার যৌবনকালকে কীভাবে অতিবাহিত করেছে?’ (তিবরানী)।
সময়ের সদ্ব্যবহার করে অনেকেই সফলতার উচ্চ শিখরে পৌঁছতে পেরেছেন। হজরত লোকমান হেকিম একজন হাবশি গোলাম হওয়া সত্ত্বেও তিনটি ভালো গুণের কারণে একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে পরিগণিত হতে পেরেছেন। তার মধ্যে সময়ের সঠিক ব্যবহার ছিল একটি। তিনি কখনোই অলস সময় ব্যয় না করে ভালোর জন্য সময় খরচ করেছেন। তার এই প্রচেষ্টা ও জ্ঞান সাধনার কারণে তিনি সফল হতে পেরেছেন।
মানুষের হায়াত সীমিত। কিন্তু কাজ অনেক। তাই এই স্বল্প সময়ে দুনিয়ার নেক আমলের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করে নিতে হবে। সময়ের প্রতি যত্নবান না হলে বেলাশেষে একদিন আফসোস ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
কিন্তু এই সময়কে যারা সঠিকভাবে ব্যবহার করেছেন তারা যুগবিখ্যাত আলেমেদ্বীনে পরিণত হয়েছেন। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) মৃত্যুশয্যায় শায়িত থেকেও ফিকহি মাসআলা নিয়ে চিন্তারত ছিলেন। সময়ের ব্যাপারে তিনি একটা সচেতন । হজরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বলেন,‘সেদিন আমি অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছি, যেদিন সূর্য অস্ত গিয়েছে, আমার আয়ু কিছুটা হলেও ফুরিয়ে গেল অথচ আমার আমলের কোনো উন্নতি হলো না!’
ওমর ইবন আবদুল আজিজ বলতেন,‘তোমরা দিন-রাত কাজে ডুবে থাক, দেখবে সময়ও তোমাদের মাঝে ডুবে রয়েছে! ঘৃণার আলামত সময় নষ্ট করা। আর এটি একটি তলোয়ার ন্যায় তুমি তাকে নষ্ট না করলে সেও তোমাকে নষ্ট করবে না। সর্বদাই ভালো অবস্থান থেকে আরো উন্নত অবস্থানের জন্য প্রচেষ্টা করা মুমিনের উপর ওয়াজিব। (আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী, মুসলিম জীবনে সময়)। সুতরাং সময়ের সঠিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জীবনকে সার্থক করে নিতে হবে। যাতে একজন মুমিন বান্দা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশের পথ সুগম হয়।