ফিরোজ আহমেদ: অপু নামের সাংবাদিকতা বিভাগের এক সাবেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। দেয়ালজুড়ে তাকে নিয়ে নানা স্মৃতিচারণ, আর কথা দেখতে পাচ্ছি। লিখেছেন ফাহমিদ ভাই, লিখেছে বেনজির, লিখেছে সামান্তা, লিখেছে আরিফ, লিখেছে আরও অনেকে এ রকম একটা মৃত্যু আক্রান্ত দিনে বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই মরে যায়। ফাহমিদ ভাইয়ের স্মৃতিচারণ পড়ে একজন যোগ্য শিক্ষার্থী কীভাবে এমনি ধীর প্রক্রিয়ায় মরে যেতে থাকেন, আর শিক্ষক নামের বহু বিকারগ্রস্ত কীভাবে সেই প্রক্রিয়াটা দেখভালো করার, নিশ্চিত করবার কাজের পুরোহিত হন, সেটা আবারও মনে পড়লো। এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অপুরা বাঁচবে কীভাবে। কালকে আরও একটা ঘটনা ঘটেছে, দেখেছেন সবাই। পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নিজের মোটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন আর এক নিম্নবিত্ত রোদেপোড়া তরুণ।
ধরনে পার্থক্য থাকুক, মনস্তাত্বিক হতাশার দিক দিয়ে দেখলে বুঝবেন খুবই সম্ভাবনা আছে যে একই রকম হতাশা আর আত্মগ্লানির শিকার ওই মোটরসাইকেল চালানো যুবকও। নিজের জীবিকাটা পুড়িয়ে দেওয়ার চাইতে সামান্য কয়েক ধাপ পরের পরিস্থিতি হতে পারে নিজের জীবনটাকেই পুড়িয়ে দেওয়া। রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানো এই মানুষগুলোর কাছ থেকে যে জরিমানাটা আদায় করা হয়, তার একটা বড়সড় ভাগ পুলিশ পান, ফলে জরিমানা আদায়ে তাদের উৎসাহ থাকে অসীম, সমস্যার সমাধানে না। নিজের ছোট একটা ব্যবসা ছিলো এই যুবকের, সেটা ডুবে যাওয়াতে কাজ নিয়েছেন যাত্রী পরিবহনের, জানি না মোটর সাইকেল পুড়িয়ে এরপর কোথায় যাবেন তিনি। এই হতাশা আর ক্রোধ কিন্তু শুধু অর্থনৈতিক না। আপনি শিক্ষক হতে চান, আপনাকে তারা অন্যায্যভাবে খারাপ ফলাফল ধরিয়ে দেবে।
মধ্য বয়েসে আর মোটর সাইকেলই চালাতে চান না, আপনাকে কাগজপত্র আটকে রাখা পুলিশ কর্মকর্তাটার কাছে কাকুতিমিনতি করতে হবে যেন বড় মামলা না দেয়,যেন কমের ওপর দিয়ে যায়। আপনি সমাজটার গঠনে নিজের মতো প্রকাশ করতে চান, মধ্যরাতের নির্বাচন আপনার মাথায় চাপিয়ে দেবে। অসহনীয় এক গুন্ডাতন্ত্র আমাদের রুটিকে কেড়ে নিচ্ছে, আমাদের আত্মাকে পিষে মারছে।
আমাদের সমাজে বৈভব আর দারিদ্র, দুটিরই তো কারণ এক। দুর্নীতিবাজদের যাবতীয় চাকচিক্য এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় অবক্ষয়ের কাহিনী ওই মোটরসাইকেল পোড়ানো যুবক আর গামছায় নিজেকে ঝুলিয়ে দেওয়া তরুণের জীবনের গল্প। দুর্নীতিবাজরা এখন আর লজ্জায় লুকিয়ে থাকে না,তারাই সবার সামনে দিনরাত উপদেশ দেয়। ফলে গভীর এক আত্মিক হতাশা আমাদের পুরোটাকে গ্রাস করছে। মানুষ আধখেয়েও বাঁচতে রাজি থাকে, যদি তার মানে থাকে। এমন মানহীন, মর্যাদাহীন চারদিকে বেঁচে থাকাটা ভয়াবহ কঠিন। কিছুই নড়ানো যায় না বলে কখনো কখনো মানুষ আত্মঘাতী হয়,নিজেকেই সরিয়ে নেয়।নিজেদের নিয়েই গ্লানি জাগার মতো সময় এটা। বিপুল অন্ধকারে যে হারিয়ে গেলো, তারও চাইতে বড় অন্ধকারে আমরা নিজেরা সকলে ডুবে আছি। রায়হান লিখেছে অপুকে নিয়ে, সেটাই খানিকটা শক্তি যোগালো, আপনাদেরও তা পড়তে দেই, যদি অপুকে আরেকটু চেনা যায়, কাকে হারিয়েছি আমরা, তার খানিকটা আভাস মেলে:‘অপু ভাই একবার বললো,ভালো মানুষ হতে পড়ালেখা করা লাগে না, কিন্তু খারাপ মানুষরে আটকাইতে হলে পড়ালেখা লাগে। সেজন্য পড়বি।’