শরিফুল হাসান: এই যে মোমবাতি নিজে পুড়ে আলো দেয়, সেই মোমবাতি হওয়া কিন্তু সহজ কাজ নয়। কারণ আলো দেওয়ার জন্য আগে নিজেকেই পুড়তে হয়। বিখ্যাত কবি, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক গুরু জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমির কথা। আগেও লিখেছি, রুমীর কথাটা শুনতে খুব সহজ হলেও নিজেকে পুড়িয়ে আলো দেওয়ার কাজভীষণ কঠিন। কারণ নিজে পুড়ে যারা পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রে আলো জালায় বা জ্বালানোর চেষ্টা করে তারা প্রতিদিন ভেতরে ভেতরে কতোটা পুড়ে আমরা অনেকেই সেটা অনুধাবন করতে পারি না! মানুষের জন্য ভাবতে গিয়ে সবসময় কষ্ট পাওয়া, সবার কষ্ট নিজের মধ্যে ধারণ করে হাসিমুখে থাকা খুব সহজ কাজ না! তবু কেউ কেউ সেই কাজটা করে। নিজেকে পোড়ানোর যন্ত্রণা জানতেন বলেই রুমী আবার সমস্যার সমাধানও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তোমার হৃদয়ে যদি আলো থাকে, তাহলে ঘরে ফেরার পথ তুমি অবশ্যই খুঁজে পাবে। তার মানে নিজেকে পুড়িয়ে মানুষকে আলো দেখাও। তুমি নিশ্চয়ই হারবে না।
জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি, যিনি কী না মাওলানা রুমি বা মৌলভি রুমি নামেও পরিচিত, তিনি ছিলেন তের শতকের ফার্সি কবি। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক, অতীন্দ্রিবাদী এবং সুফী। রুমির প্রভাব আজ দেশের সীমানা এবং জাতিগত পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারে ছড়িয়েছে। রুমী সবসময় বলতেন, মনের আনন্দে বাঁচো। আমরা অনেক সময়ই মন যা চায় সেই কাজে থাকতে পারি না। এক্ষেত্রে রুমীর উপেদশটা শুনুন- ‘প্রতিটি মানুষকে একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং সেই কাজটি তার হৃদয়ে গ্রন্থিত আছে। প্রতিটি মানুষ ভেতর থেকে ঠিক সেই কাজটি করার জন্যই তাড়না অনুভব করে। কাজেই মনের ভেতর থেকে যা চায় তাই করো।’
কথাটা ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। আপনারা গান গাইতে ভালো লাগলে গান গান, কবিতা লিখতে ভালো লাগলে তাই করেন, ডাক্তারি ভালো লাগলে করেন। মানে যেই কাজটা আপনি মনের ভেতর থেকে অনুভব করেন তাই করেন। শুধু মিথ্যা অহঙ্কার কইরেন না। নিজেকে বিশাল বড় কিছু মনে না করে সাধারণ মানুষ ভাবুন। মানুষকে মিথ্যা অহঙ্কার না করার পরামর্শ দিয়েছেন রুমী। তিনি বলেছেন, যে বাতাস গাছ উপড়ে ফেলে, সেই বাতাসেই আবার ঘাসেরা দোলে। কাজেই বড় হওয়ার দম্ভ কখনও করো না। এই কথাগুলো আমার ভীষণ পছন্দের। আমি শরিফুল হাসান সবসময় নিজেকে একটা কথা বলি। আমার সহকর্মী, পরিচিতজনদেরও বলি। আমি বারবার বলি যে আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে আকাশ ছোঁয়ার কিন্তু বিনয়ে চোখ থাকতে হবে মাটিতে। এর নাম বিনয়। অথচ এই দেশে হয় উল্টো। আমরা কাজ করি খুব সামান্য, কিন্তু ভাব নেই আকাশের মতো। ওপরওয়ালা আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা যেন বিনয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে চলতে পারি। যেন সত্যিকারের মানুষ হতে পারি। সবসময় যেন সৎ থেকে আয়টা হালাল রাখতে পারি। যেন সবসময় মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারি। যেন সাধারণ জীবন যাপন করতে পারি। এই কয়টা ছোট পরামর্শ মাথায় রাখলে দুনিয়ার প্রায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এ কারণেই বোধহয় রুমী বলেছেন, প্রদীপ হও, কিংবা জীবনতরী, অথবা সিঁড়ি। কারো ক্ষত পূরণে সাহায্য করো। আসুন সবাই মিলে পরষ্পর ভালো থাকি। ভালো রাখি। সবার কথা ভাবি। মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের পাশে দাঁড়াই। আরেকজনের ক্ষত পূরণে সাহায্য করি। প্রদীপ হই, কিংবা জীবনতরী, অথবা সিঁড়ি। কারণ মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যেই জীবনের আসল অর্থ। ফেসবুক থেকে