স্বকৃত নোমান: এক আলাদা মানুষ ছিলেন কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী। জীবনকে অত সিরিয়াসভাবে নেননি। জীবন ছিল তাঁর কাছে সিগারেটের ধোঁয়ার মতো। উড়িয়ে দাও যেমন খুশি। কথাবার্তায় আমাদের মতো এত রাখঢাক করতেন না। কোনো কিছু আড়াল করতেন না। মনের মতো মানুষ পেলে জীবনের ব্যক্তিগত গোপন কথাটি বলে ফেলতেন নিঃসঙ্কোচে। একবার জাতীয় জাদুঘরের পক্ষ থেকে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। প্রায় তিন ঘণ্টার ভিডিও সাক্ষাৎকার। গোপন কথাগুলো অকপটে বলেছিলেন। সাক্ষাৎকার শেষে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনি গোপন কথাগুলো এভাবে বলে বসলেন! সাহস আছে আপনার।’ তিনি বললেন, ‘এসব ঘটনা-দুর্ঘটনা-অভিজ্ঞতা নিয়েই তো আমার জীবন। এগুলো তো আমার জীবনেরই অংশ। আমি লুকাবো কেন?’
তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ রচনা’ বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখাটি লিখেছিলাম আমি। আমার নামেই ছাপা হয়েছিল। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দেশে এত লেখক থাকতে আপনি আমাকে দিয়ে এটা লেখালেন কেন?’ বললেন, ‘আপনি তরুণ, তাই। আমি তরুণদের ভালোবাসি। তরুণরাই আমার বন্ধু। আমার ইচ্ছে ছিল একজন তরুণ লেখক আমার বইটি নিয়ে লিখবে। আমার মনে হয়েছে আপনি সেই তরুণ। নেন, সিগারেট খান।’
বলেই তিনি একটা সিগারেট বাড়িয়ে ধরলেন। বলা বাহুল্য, সেটা সিগারেট ছিল না, ছিল গাঁজা। আমি বললাম, ‘ভাই, এই জিনিস আমি খেতে পারি না। খেলে চন্দ্র-সূর্যের গায়ে নিজেকে সম্রাট শাহজাহান রূপে দেখতে পাই।’ তিনি বললেন, ‘ধুর মিয়া, খান তো! আজ আমার সঙ্গে খেয়ে দেখেন। খেলে এবার চন্দ্র-সূর্যের গায়ে নিজেকে সম্রাট আলেকজান্ডার রূপে দেখতে পাবেন।’ বলেই হাসলেন। কিন্তু আমি সাহস করিনি।
বুলবুল ভাই আগাগোড়াই লেখক ছিলেন। এক লেখক জীবন যাপন করে গেছেন। এমন পুরোদস্তুর লেখক খুব কমই দেখেছি জীবনে। বেশ কিছুদিন কর্কট রোগের সঙ্গে লড়েছেন। রোগকে পাত্তা দেননি। অসুস্থ অবস্থায়ও তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে একাধিকবার। রোগশয্যায় শুয়ে তাঁকে দেখেছি ডোন্ট কেয়ারভাবে সিগারেট ফুঁকতে। মৃত্যু নিয়ে দুর্ভাবনা ছিল না তাঁর। মৃত্যু নামক চরম সত্যকে মেনে নেওয়ার দুর্বার ক্ষমতা ছিল তাঁর। তিনি চলে গেলেন। তাঁর প্রতি অন্তিম শ্রদ্ধা। লেখক : কথাসাহিত্যিক
আপনার মতামত লিখুন :