সাঈদ তারেক: ভিনদেশের দালালদের শেষ পরিনতি কি দাঁড়ায় একবার দেখেছিলাম ’৭১ -এর ১৬ ডিসেম্বরের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, আর গত ক’দিন ধরে দেখছি আফগানিস্তানে! প্রাণ বাঁচানোর জন্য মানুষের প্রাণান্ত চেষ্টা। পালাচ্ছে। যে যেদিকে পারছে ছুটছে। বিমান বন্দরের নিরাপত্তা বেস্টনী ভেঙে রানওয়েতে ঢুকে পড়ছে। চলন্ত প্লেনের পিছু পিছু, কেউ বিমানের ছাদে কেউ চাকার সাথে ঝুলছে। গত দু’দিন সিএনএন, আল জাজিরায় এমনসব অবিশ্বাষ্য দৃশ্যই দেখছিলাম। আফগানিস্তানের ঘটনায় আসলে এটাই প্রমাণ হলো, স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে বা প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কোনো বিদেশি প্রভুই আর পেছন ফিরে তাকায় না। দালালদের তখন রাস্তায় কুকুরের মতো মরতে হয়, প্রাণভয়ে ভিনদেশে ছুটতে হয়, প্রভুদেশও তাদেরকে ঠাঁই দেয় না।
বিদেশি শক্তির ওপর ভরসা করে যারা ক্ষমতায় টিকে থাকে- তারা আসলে ভীরু কাপুরষ। নৈতিক মনোবলহীন এবং দুর্বল চিত্তের। তারা ততোদিনই বাহাদুর যতোদিন প্রভু তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়, ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখে। পরশু রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রেস ব্রিফিংটি লাইভ শুনছিলাম। ভদ্রলোক অনেক কথার মধ্যে একটা ভালো কথা বলেছেন। ‘কেউ যদি যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে আমরা কেন তাদের জন্য মরতে যাবো।’ মরতে তারা গেছিলেন এবং মরেওছেন। বিশ বছরে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে হাজার হাজার মার্কিন সৈন্যের প্রাণের বিনিময়ে কি অর্জনটা করে এলেন! গণতন্ত্র কায়েম দূরের কথা একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী টেকসই সমাজ কাঠামো বা জন সমর্থন- কোনোটাই তো হলো না। শুধু আল-কায়দা নিধন?- যেমনটা বাইডেন বললেন। এমন এক সরকারকে বিশ বছর খাইয়ে দাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করলেন যারা তালেবান আসছে শুনেই পালাতে শুরু করলো। এমন এক প্রেসিডেন্টকে প্রমোট করলেন যিনি কিনা পালালেন সবার আগে।
এমন এক সেনাবাহিনী লালন-পালন করলেন যারা তালেবানদের সঙ্গে লড়াই করার পরিবর্তে দল বেঁধে সীমান্ত অতিক্রম করে ভিনদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করলো। ন্যুনতম প্রতিরোধও মালুম করলো না তালেবানরা। মার্কিন সৈন্য দেশত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে একের পর এলাকা দখল- একেবারে বিনা বাধায়। রাজধানী কাবুলে ঢুকে গেলো হাঁটতে হাঁটতে। আমার মনে হয় এইরকম পরিস্থিতি দেখে তালেবানরা নিজেরাও বেকুব হয়ে গেছে। বেকুব হয়ে গেছে বাঘা বাঘা সব সমরবিদ পণ্ডিত গবেষক বিশ্লেষক। গোটা বিশ্ব হতবাক। মানব জাতির ইতিহাসে সম্ভবত: এই প্রথম একটি যুদ্ধ যেখানে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী লড়াই করেছে গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে। কেউ ছিলো না পক্ষে। প্রকাশ্যে তো নয়ই গোপনে কেউ সাহায্য সহযোগীতা করলেও প্রকাশ্যে অস্বীকার করেছে। আমি বিষ্ময়াভিভূত। তালেবানরা শুধু আফগানিস্তান দখল করেনি, ইতিহাসে এক অনন্য নজীর স্থাপন করলো।
আমি তালেবানদের রাজনীতি কম বুঝি। একবিংশ শতকে প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে দেড় হাজার বছর আগের সমাজ কাঠামো বা রীতি নীতির সমন্বয় কীভাবে ঘটাবে সেটাও পরিষ্কার না, তবে তাদের দেশপ্রেম, সাহস, লক্ষ্যের প্রতি অবিচল আস্থা মূল্যবোধের দৃঢ়তাকে সম্মান জানাই। টানা দুই দশক দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়লাভ করেছে- এ বিজয় অন্যান্য নিপীড়িত পরাধীন জনগোষ্ঠীর জন্যও উৎসাহব্যাঞ্জক, সন্দেহ নেই। ‘তালেবান’ অর্থ ছাত্র। প্রথম আন্দোলনটি শুরু করেছিলো মাদ্রাসা মক্তবের ছাত্ররা। সেই থেকে ‘তালেবান’। তবে কালেক্রমে এতে শুধু ছাত্ররাই থাকেনি যুক্ত হয়েছে শিক্ষকরা ধর্মীয় গুরুরা, অন্যান্ন শ্রেনী পেশার মানুষ। এখন যারা দেশ চালাবে তারাও ছাত্র নয়। রাজনীতিবিদরাই দায়িত্ব নেবেন। সঙ্গত কারণেই যোদ্ধারা অনভিজ্ঞ। বিশটি বছর কেটেছে পাহারে বনে জঙ্গলে। আধুনিক ডিপ্লোমেসি, ঘোরেল সব প্লেয়ারদের সঙ্গে চালবাজিতে কতোটা পেরে উঠবেন, কতোদিন তারা এক থাকতে পারবেন, কতোদিন অন্যের দাবার গুটি হওয়া থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন তার ওপর নির্ভর করছে ক্ষমতায় তালেবানদের স্থিতিকাল।
আমি আফগানিস্তান নামের দেশটায় স্থিতিশীলতা কামনা করি, মানুষ যেন আর কোনো নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার না হয়। এগিয়ে যাক শান্তি সমৃদ্ধির পথে। আর কোনো দখলদার যেন এসে ঘাঁটি গাড়তে না পারে এই দেশটায়। ফেসবুক থেকে