মোরশেদুল আলম: নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে নদীগুলো জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ছোট-বড় সব মিলিয়ে সাত শতাধিক নদী আছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে সরকারি হিসাবে রংপুর অঞ্চলে আছে ১৮টি নদী। তবে একটি বেসরকারি সংস্থার এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, রংপুর অঞ্চলে মোট নদীর সংখ্যা ৮২, যার অধিকাংশই অস্তিত্ব সংকটে। এত নদীর বদৌলতে সমৃদ্ধ জনপদ হতে পারত রংপুর তথা দেশের উত্তরাঞ্চল। কিন্তু এসব নদী সৌভাগ্যের পরিবর্তে যেন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে।
রংপুর অঞ্চল তথা দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা কুড়িগ্রাম। প্রতিবছর বন্যার সময় গোটা কুড়িগ্রাম জেলা পরিণত হয় একটি নদীতে। ফসল ও জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। বন্যার পানি কমতে না কমতেই শুরু হয় নদী ভাঙন। মূলত বন্যা আর নদী ভাঙনের কাছে অসহায় এ জেলার মানুষ। প্রতি বছর অবধারিত এ দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না পেরে সম্ভাবনাময় কুড়িগ্রাম জেলায় ক্রমেই দরিদ্রের হার বাড়ার তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে আসছে।
বিগত এক দশকে কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেশকিছু গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ বছরও অব্যাহত রয়েছে নদী ভাঙন। বিশেষ করে জেলার রাজারহাট উপজেলার কয়েকটি গ্রাম বেশি ভাঙনের শিকার হয়ে এখন বিলিনের পথে। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে উপজেলার মানচিত্র। ইতোমধ্যে সেখানকার কয়েক হাজার মানুষ নিজেদের ভিটাবাড়ি হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছে অন্যের জমিতে অথবা সরকারি রাস্তায়। অত্র এলাকার ফসলি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ও স্থাপনা ইতোমধ্যে ভাঙনের শিকার হয়েছে। তিস্তার ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে আরও অনেক এলাকা।
এ বছর নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ভাঙন। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার পরিবার নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। এলাকার লোকজন তিস্তাকে রাজারহাটের দারিদ্র্য তৈরির কারিগর বলে থাকে। তিস্তা প্রতিবছর রাজারহাটে শতাধিক দারিদ্র্য তৈরি করে থাকে। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটচ্ছে অসহায় পরিবারগুলোর। ভিটা-বাড়ি হারা এসব মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর যেন কেউ নেই! এখানকার হাজার হাজার মানুষ যেন অভিভাবকহীন। তাদের অসহায়ত্ব সবাই দেখতে পান সত্যি। কিন্তু তাতে কর্তৃপক্ষের উদ্বেগের কোনো কারণ থাকে না। তাই তো সেখানে প্রতিকারমূলক কোনো ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায় না।
এবারের নদী ভাঙনের ধরন অন্যান্যবারের থেকে আলাদা। এটা না দেখে তার ভয়াবহ লেখনির ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জিও ব্যাগ ও বোল্ডার ফেলা হয়েছে, যা নদী ভাঙন রোধে তেমন কোনো ভূমিকা রাখছে না। ইতোপূর্বে রাজারহাট উপজেলা প্রশাসন ক্রসবাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। উল্টো আগে উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউপির বুড়িরহাট এলাকায় যে, বাঁধটি ছিল, সেটিও নদীতে বিলীন হওয়ার উপক্রম। স্থানীয়রা এই বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। তারা নদী ভাঙন রোধে স্থায়ী ও টেকসই সমাধান চায়। ইতোপূর্বে সরকারের পক্ষ থেকে ওই এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী নদী খননের কথা বলা হয়েছিল। আমরা চাই সরকার তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করুক।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের অন্যান্য জেলার মতো কুড়িগ্রাম জেলার মানুষও সমান সুবিধা ভোগের দাবিদার। রাষ্ট্রের উচিত এখানকার বিদ্যমান সংকট নিরসন করা। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে বন্যা ও নদী ভাঙনের একই দৃশ্য চিত্রায়িত হলেও কোনো প্রতিকার মিলছে না। বর্তমান সরকার কুড়িগ্রামের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নদী ভাঙন রোধ না করে শত উদ্যোগেও কুড়িগ্রামবাসীর দুঃখ ঘুচবে না। সেইসঙ্গে কমবে না দারিদ্র্য বাড়ার হার। শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর