অনলাইন ডেস্ক: সিলেটের টিলাগড় এলাকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে ঢুকলেই চোখে পড়ে বড় কয়েকটা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা বেশকিছু প্রাণীর খাঁচা। হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে, হয়তো সংস্কারকাজ চলছে। আদতে সংস্কারকাজ নয়, এসব খাঁচার ভেতরে বাস করছে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা বিভিন্ন জাতের পাখি। ম্যাকাও, লাভ বার্ড, বাজরিগার, চুকার পেকটাসসহ বিভিন্ন জাতের পাখি রয়েছে এখানে।
সংরক্ষণ কেন্দ্রের আরেকটু ভেতরে যেতেই এমনভাবে ঢেকে রাখা আরো বেশ কয়েকটি খাঁচা চোখে পড়ে। এর মধ্যে ময়ূর ও অজগরের খাঁচাও রয়েছে। এমনভাবে সেগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে যে আলো-বাতাসও প্রবেশ করতে পারছে না।
প্রাণীগুলোকে এভাবে ঢেকে রাখার কারণ জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের কর্মী আব্দুল কাদির বলেন, নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এখানে মানুষজনের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে সংরক্ষণ কেন্দ্রের ভেতরের সড়ক দিয়ে এলাকার অনেক মানুষ যাতায়াত করে। তারা অনেক সময় পাখি ও প্রাণীদের বিরক্ত করে। তাই স্থানীয়রা যেন এসব পাখি ও প্রাণী দেখতে না পারে, সেজন্যই খাঁচাগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে।
পরিবেশবিদরা জানিয়েছেন, আলো-বাতাসহীন অবস্থায় ঢেকে রাখার কারণে প্রাণীর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এমনকি প্রাণীগুলোর প্রাণহানিও হতে পারে।
২০১৮ সালের ২ নভেম্বর সিলেট নগরীর টিলাগড় ইকোপার্কে এ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র চালু করা হয়। শুরু থেকেই নানা অভিযোগ ওঠে এটির বিরুদ্ধে। অব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার অভাবে কেন্দ্রের বেশকিছু প্রাণীর মৃত্যুও হয়েছে। এখন যেগুলো আছে, সেগুলোর অবস্থাও খুব ভালো বলা যাবে না। নয় প্রজাতির ৫৮টি প্রাণী নিয়ে যাত্রা হয়েছিল কেন্দ্রটির। আড়াই বছরের মধ্যেই মারা গেছে অজগর-ময়ূরসহ অন্তত ৩০টি প্রাণী। বর্তমানে কেন্দ্রটিতে বিভিন্ন জাতের পাখি, অজগর, দুটি ময়ূর, জেব্রা, হরিণ, খরগোশসহ কিছু প্রাণী রয়েছে।
দায়িত্বরত কয়েকজন কর্মী জানান, ইকোপার্কের ভেতর দিয়ে অবাধে যানবাহন চলাচল করে। এসবের শব্দ ও দূষণ প্রাণীদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত নয়। করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে যানবাহন চলাচল কমায় প্রাণী মৃত্যুর হার কমেছে বলে দাবি করেন তারা।
সম্প্রতি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের মূল ফটক বন্ধ রয়েছে। কোনো দর্শনার্থী প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তবে সংরক্ষণ কেন্দ্রের ভেতরের সড়ক দিয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা যাতায়াত করছে। কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ত্রিপল দিয়ে ঢাকা খাঁচা। কেবল হরিণ ও জেব্রা ছাড়া সব প্রাণীর খাঁচা ঢেকে রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে সিলেট বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের অস্থায়ী প্রাণীশালা রক্ষক মো. মাসুদ হাওলাদার বলেন, দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ রাখতে ও স্থানীয়দের উৎপাত থেকে রক্ষা করতে এগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে। তবে নিয়মিত খাবার-দাবার দেয়া হচ্ছে। সংরক্ষণ কেন্দ্রের ভেতর দিয়ে যে সড়ক গেছে, তা দিয়ে আশপাশের কয়েকটি এলাকার মানুষ যাতায়াত করে। ফলে চাইলেও আমরা মানুষজনের প্রবেশ পুরো বন্ধ রাখতে পারি না। অনেক সময় দেখা যায় যাওয়া-আসার সময় মানুষজন খাঁচার ভেতরের প্রাণীদের বিরক্ত ও খোঁচাখুঁচি করে। এ কারণে অনেক প্রাণী মারাও গেছে। দিনের বেলা আমরা পাহারা দিতে পারি। কিন্তু রাতে পাহারা দেয়া সম্ভব হয় না। তাই আমরা প্রাণীগুলো ঢেকে রেখেছি।
কভিডের সংক্রমণজনিত নিষেধাজ্ঞা শেষ হলে আবার খাঁচাগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
তবে এভাবে ঢেকে রাখার কারণে প্রাণীদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম। তিনি বলেন, প্রাণীদের পূর্ণ বিকাশের জন্য প্রচুর আলো-বাতাস প্রয়োজন হয়। কেবল খাবার খেয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। পাখি যদি আকাশই দেখতে না পারে, তবে সে বিকশিত হবে কী করে। এছাড়া এভাবে খাঁচা ঢেকে রাখার ফলে অক্সিজেনেরও ঘাটতি দেখা যেতে পারে। ফলে অনেক প্রাণী মারাও যেতে পারে।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এরই মধ্যে হয়তো অনেক প্রাণী মারাও গেছে। যেহেতু করোনাকাল, তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি না বা মৃত্যুর খবর পাচ্ছি না।
ত্রিপল দিয়ে প্রাণীদের এভাবে ঢেকে রাখা ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এসএম সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলেন, এ বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এভাবে ঢেকে রাখার কথা না। আমি খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।
সম্প্রতি কোনো প্রাণী মারা গেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুরুর দিকে অচেনা পরিবেশ, শব্দ ও বায়ুদূষণের কারণে কিছু প্রাণী মারা গিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এখানে কোনো প্রাণী মারা যায়নি।
প্রাণীর মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাইলে অস্থায়ী প্রাণীশালা রক্ষক মো. মাসুদ হাওলাদার জানান, শব্দ ও বায়ুদূষণ ছাড়াও ছোট খাঁচায় আবদ্ধ থাকা ও এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এসে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে শুরুর দিকে কিছু প্রাণী মারা গেছে। কিন্তু এখন প্রাণীরা ভালো থাকলেও এসব সমস্যার কারণে এ কেন্দ্রে প্রাণীদের প্রজনন হচ্ছে না। - বণিক বার্তা