শিরোনাম
◈ মুগদায় ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় কিশোর নিহত ◈ বাংলাদেশ-চীন সামরিক মহড়া মে মাসে, নজর রাখবে ভারত ◈ দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু: চুয়েটে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত, যান চলাচল শুরু ◈ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ভারত, চীন বা রাশিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত নয়: মার্কিন কর্মকর্তা ◈ সিলেটে ট্রাক-অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত ২ ◈ থাইল্যান্ডের রাজা-রাণীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ ◈ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় ◈ শিক্ষক নিয়োগ: ১৪ লাখ টাকায় চুক্তি, ঢাবি শিক্ষার্থীসহ গ্রেপ্তার ৫ ◈ বিদ্যুৎ-গ্যাস কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র ছাড়া ঋণ মিলবে না ◈ নতুন করে আরও ৭২ ঘণ্টার তাপ প্রবাহের সতর্কতা জারি

প্রকাশিত : ০৩ জুলাই, ২০২১, ১০:৫০ দুপুর
আপডেট : ০৩ জুলাই, ২০২১, ১০:৫০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

যুদ্ধ ও ব্যবসা, দু’টোই বোঝেন শি

রাশিদ রিয়াজ : ‘শি জিনপিং থট’। এই শব্দগুলি কয়েক বছর আগে লেখা হয়েছে চীনের সংবিধানে। এতদিন সেখানে ‘মাও সে তুং থট’ বা মাও চিন্তাধারার কথা লেখা ছিল। চীনা কমিউনিস্টরা মনে করত, মাওয়ের দর্শন ও কর্মপদ্ধতি চীনের এগিয়ে চলার পথে দিকনির্দেশ করবে। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্টকেও একই সম্মান দিয়েছে পার্টি। অতএব শি জিনপিং এখন কেবল প্রশাসনের এক নম্বর ব্যক্তি নন। চীনাদের কাছে তিনি মস্ত বড় দার্শনিক, যিনি দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাবেন। দি ওয়াল

সাধারণত চীনে কেউ দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। কিন্তু শি-এর জন্য সেই নিয়ম বদলানো হয়েছে। ২০১৮ সালে চীনের সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে, শি আজীবন চীনা প্রশাসনের শীর্ষ পদটিতে থাকতে পারবেন।

দুঃখের দিনগুলি

মাওয়ের আমলে শি-র দুর্দশার অন্ত ছিল না। তার জন্ম ১৯৫৩ সালে। অর্থাৎ বিপ্লবের কয়েক বছর পরে। বাবা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা। নাম শি ঝোংশুন। শি-ও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্টির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। কিন্তু বিপদ ঘনিয়ে এল ১৯৬৬ সালে।

পাঁচের দশকের শেষদিকে চীনে যৌথ খামার গড়তে চেষ্টা করেন মাও। তার ফলে দেখা যায় ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে অনেকে মাওয়ের বিরোধী হয়ে ওঠেন। শি-এর বাবা ছিলেন তাদের দলে।

দেশের ছাত্র-যুবদের কাছে তখনও মাওয়ের প্রভাব ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে আহ্বান জানালেন, তোমরা প্রকাশ্যে পার্টি নেতৃত্বের সমালোচনা কর। কারণ তাদের অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তোমরা তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য কর।

এর নাম সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এই বিপ্লবে মাওয়ের শত্রুরাই মূলত ছিলেন লক্ষ্য। যেহেতু শি-এর বাবা মাওয়ের বিরোধী, তাই তরুণ শি-ও পড়লেন পার্টির কোপে। তাকে দল থেকে তাড়ানো হল। শুধু তাই নয়, তাকে বলা হল, গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে চাষের কাজে অংশ নিতে হবে। মাওয়ের বিরোধিতা করে তিনি যে পাপ করেছেন, কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত হবে।

এই অবস্থায় শি-র পক্ষে পার্টির বিরোধী হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তিনি অন্য ধাতুতে গড়া। বয়সে তরুণ হলেও আবেগের বশে চলতেন না। সবসময় ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতেন। তিনি বুঝেছিলেন, চীনে কমিউনিস্ট পার্টি এখনও অনেকদিন রাজত্ব করবে। সুতরাং মনে যাই থাক, তিনি বাইরে দেখাতে লাগলেন যেন মাওয়ের কত অনুগত। অনেক কষ্টে ১৯৭৪ সালে পেলেন পার্টির সদস্যপদ।

ক্রমে উত্থান

সমস্ত সফল ব্যক্তির মতোই শি জানেন, কীভাবে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। কখন কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হয়। তিনি যখন পার্টির সদস্যপদ পাচ্ছেন, তখন চীনে মাওপন্থীদের রাজত্ব। শি তাদের সঙ্গে দিব্যি বন্ধুত্ব করে ফেললেন। আবার পরে যখন তেং-শিয়াও-পিং-এর জমানা শুরু হল, মাওপন্থীদের তাড়ানো হতে লাগল, শি টুক করে ভিড়ে গেলেন মাও বিরোধী শিবিরে।

পার্টিতে যোগ দেওয়ার পরে শি-এর কেরিয়ারগ্রাফ উঠতে শুরু করে। একসময় তিনি ছিলেন হেবেই প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক। সেখান থেকে হলেন সাংহাইয়ের পার্টি প্রধান। উন্নতি করতে করতে একসময় পৌঁছে গেলেন পলিটব্যুরোর স্ট্যান্ডিং কমিটিতে। ২০১২ সালে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদটি এল তার মুঠোয়।

সাধারণত চীনের প্রেসিডেন্টদের স্ত্রীরা বিশেষ প্রকাশ্যে আসেন না। কিন্তু শি-র স্ত্রী হলেন গ্ল্যামার কুইন। তিনি বিখ্যাত গায়িকা। নাম পেং লিউয়ান। তাদের মেয়ে কিন্তু লো প্রোফাইলে থাকেন। তার নাম শি মিংজে। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।

শি নিজে চীনের সিংঘুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি পেয়েছিলেন। এমনিতে তিনি আমেরিকার যতই বিরোধী হন, নিজের মেয়েকে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন সেই দেশে।

এত ক্ষমতার উৎস কী

মাও ছিলেন দক্ষ সেনাপতি। তিনি না থাকলে তৎকালীন চীনের শাসক চিয়াং কাইশেক কবেই কমিউনিস্টদের ধরে কচুকাটা করতেন। মাওয়ের সেনাপতিত্বে পার্টি ধ্বংসের কিনারা থেকে ফিরে এসেছিল। শুধু তাই নয়, লালফৌজ একসময় জিতে নিয়েছিল বেইজিং। সুতরাং তিনি যে বিরাট ভাবমূর্তির অধিকারী হবেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু শি এমন কী করেছেন যে, চীনারা তাকে মাওয়ের মতো সম্মান করছে?

শি হলেন স্বপ্নের সওদাগর। তিনি চীনের মানুষকে বুঝিয়েছেন, দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাবেন। আমেরিকাকে পিছনে ফেলে চীনই হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। চীনারা সকলেই বড়লোক হয়ে যাবে।

শি কাজের মানুষ। বাজে বকেন না। ক্ষমতায় এসেই কয়েক লাখ দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা ও অফিসারকে তাড়িয়েছেন। উঁচু পদের প্রশাসনিক কর্তারাও রেহাই পাননি। নিন্দুকরা বলে, শি দুর্নীতি দমনের নাম করে দলে ও প্রশাসনে নিজের শত্রুদের তাড়িয়েছিলেন।

একুশ শতকের প্রথম দিকে চীনে অর্থনীতির গতি হয়ে পড়েছিল ধীর। অনেকে আশঙ্কা করেছিল, চীনা অর্থনীতির বিকাশ স্তব্ধ হয়ে যাবে। একসময় সোভিয়েত রাশিয়ারও এই দশা হয়েছিল। সাতের দশকের শেষ দিক থেকে সেখানে জিডিপি-র বিকাশ কমতে থাকে। ন’য়ের দশকের শুরুতে নেমে এসেছিল শূন্যে। ফলে কমিউনিস্ট শাসনের পতন হয়েছিল।

শি ক্ষমতায় এসেই অর্থনীতিতে বড় সংস্কার করলেন। যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি অলাভজনক হয়ে উঠেছিল, তাদের প্রথমেই ঝেড়ে ফেললেন হাত থেকে। দেশবাসীকে বার্তা দিলেন, তিনি ব্যবসা বোঝেন। একইসঙ্গে দূষণ কমাতে ব্যবস্থা নিলেন। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, আগামী দিনে সারা বিশ্ব নির্ভর করবে গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন এনার্জির ওপরে। চীনকেও এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলে চলবে না।

ক্ষমতায় আসার পরে বেসরকারি পুঁজিকেও যথেষ্ট মদত দিয়েছেন শি। তাদের জন্য কর কমিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন বেল আউট ফান্ড। কোনও পুঁজিপতির ব্যবসা ভাল না চললে, সেই তহবিল থেকে তাদের সাহায্য করা হয়।

গত দেড় বছরে করোনা সংকটের মধ্যেও ফুলেফেঁপে উঠেছেন চীনের পুঁজিপতিরা। ইন্টারনেট, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, এই তিনটি সেক্টরের বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে সেই দেশে। গত এক বছরে চীনের ৫শ বেসরকারি কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। এর জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব প্রেসিডেন্টেরই।

তা বলে শিল্পপতিদের কেউ যদি বেয়াড়া হয়ে ওঠেন, সরকারের সমালোচনা করার সাহস দেখান, শি-র কাছে তার ক্ষমা নেই। কয়েক মাস আগে আলিবাবা গ্রুপের কর্ণধার জ্যাক মা বলেছিলেন, চীনা সরকারের নীতির জন্য নতুন প্রযুক্তি আনা যাচ্ছে না। এখন চারটি সরকারি সংস্থা আলিবাবার অনুমোদিত অ্যান্ট গ্রুপ সম্পর্কে ‘খোঁজখবর নিচ্ছে’।

আগ্রাসী চীন
শি জানেন, ব্যবসা করার জন্য চাই সামরিক শক্তি। গায়ের জোর দেখিয়ে বিভিন্ন দেশকে বশীভূত রাখতে হবে। তবেই তারা বাজার খুলে দেবে চীনের সামনে। চীনে তৈরি সস্তা পণ্যে ছেয়ে যাবে সেদেশের বাজার। গত কয়েক বছরে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। সেই বিনিয়োগ যাতে নিরাপদ থাকে সেজন্যও চাই দক্ষ সেনাবাহিনী।

শি দেশবাসীর কাছে প্রমাণ করেছেন, ব্যাবসার পাশাপাশি তিনি যুদ্ধও বোঝেন। তার আমলে দক্ষিণ চীন সাগরে শক্তি বাড়াচ্ছে চীনা নৌবহর। তারা সমুদ্রের ছোট ছোট দ্বীপগুলিতে ঘাঁটি গড়তে চায়। চীনের অনেকগুলি বাণিজ্যিক জাহাজ যাতায়াত করে দক্ষিণ চীন সমুদ্র দিয়ে। তাই ওই অঞ্চল পাহারা দিচ্ছে চীন। এই নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল ক্ষোভ জানিয়েছে একাধিকবার। কিন্তু শি তাতে কান দেননি।

চীন জানে, এশিয়া মহাদেশে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াতে পারে ভারত। তেং শিয়াও পিং-এর আমলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু শি-র নীতি অন্য। তিনি ভারত সীমান্তে ঝামেলা পাকিয়ে রাখতে চান। ভারতের অরুণাচল প্রদেশটি তিনি দাবি করেছেন। লাদাখেও ভারতের জমি দখল করার চেষ্টায় আছেন। এর পাশাপাশি তাইওয়ানের আকাশে তিনি পাঠিয়েছেন রেকর্ড সংখ্যক যুদ্ধ বিমান।

অবাধ দমন পীড়ন

শি নিজের দেশের ভিতরেও সমান আগ্রাসী। তিনি মানবাধিকারের তোয়াক্কা করেন না। শত্রুদের বিরুদ্ধে তার চাই ফ্রি হ্যান্ড।

কয়েক বছর আগে শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর জাতির লোকেরা বিদ্রোহ করেছিল। প্রেসিডেন্ট তার পর থেকে ১০ লাখেরও বেশি উইঘুরকে বন্দি করে রেখেছেন। বন্দি শিবিরগুলির নাম দেওয়া হয়েছে ‘রি-এডুকেশন ক্যাম্প’। অর্থাৎ চীনা সরকার বিদ্রোহীদের শিক্ষা দিয়ে দেশের সুনাগরিক গড়ে তুলতে চায়। ব্রিটেন ও আমেরিকার মতো দেশ একাধিকবার অভিযোগ করেছে, শিনজিয়াং প্রদেশে গণহত্যা চালিয়েছে লাল ফৌজ। শি এইসব অভিযোগে পাত্তা দেননি।

২০১৯ সালে গণতন্ত্রের দাবিতে পথে নেমেছিল হংকং-এর ছেলেমেয়েরা। শি কয়েকমাস সহ্য করেছিলেন। তারপর জারি করে দেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি ল। অভিযোগ, আন্দোলনকারীরা বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করছেন। ন্যাশনাল সিকিউরিটি আইনে কাউকে ধরলে মুশকিল। তার বাকি জীবন কাটবে জেলের অন্ধকারে।

শি প্রমাণ করেছেন, তিনি মাওয়ের মতোই স্ট্রংম্যান। চীনারা তাই তাকে আজীবন শাসক পদে রাখতে চায়। ব্যাপারটা অবশ্য গণতন্ত্রের পক্ষে খুব একটা ভাল নয়। অবশ্য চীনে আর কবেই বা গণতন্ত্র ছিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়