শিরোনাম
◈ ওড়না কেড়ে নিয়ে পুরুষ কর্মকর্তাদের উল্লাস, নারী বন্দিদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ◈ রেকর্ড উৎপাদনের সুফল কোথায়? চালের বাজারের চালকের আসনে কারা? ◈ পবিত্র আশুরা আজ ◈ তরুণ ক্রিকেটার তানভীরের ফাইফারে সিরিজ সমতায় বাংলাদেশ ◈ 'শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দখল করেছে জামায়াত': গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ◈ ১৪ হাজার কোটি রুপি কেলেঙ্কারি, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার ভারতের নেহাল মোদি (ভিডিও) ◈ মোবাইল চুরির অভিযোগকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য সালিস থেকে রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি ◈ জাতীয় নির্বাচনে বাধা দেওয়ার শক্তি কারো নেই: কেরানীগঞ্জে বিএনপি সমাবেশে সালাহ উদ্দিন আহমদের হুঁশিয়ারি ◈ তুর্কমেনিস্তানকে কাঁ‌পি‌য়ে দি‌লো বাংলা‌দেশ, এশিয়ান কাপে যাচ্ছে ঋতুপর্ণারা ◈ চী‌নে জু‌নিয়র হ‌কি‌তে একদিনে বাংলাদেশ পুরুষ ও নারী দ‌লের জয়

প্রকাশিত : ০২ জুলাই, ২০২১, ০৩:২৭ রাত
আপডেট : ০২ জুলাই, ২০২১, ০৪:৫৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বিত্তহীনদের একমাত্র সুলভ মাছ পাঙ্গাস: এক দশক ধরে দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকার নিচে

নিউজ ডেস্ক: বাজারে চাষকৃত বড় মাছগুলোর মধ্যে পাঙ্গাসের দাম তুলনামূলক কম। দীর্ঘদিন ধরেই নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে মাছটির দাম। খামার পর্যায়েও প্রায় দেড় দশক ধরে মাছটি বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ১০০ টাকার নিচে। এ সময়ের মধ্যে খুচরা বাজারে মাছটির দামে কিছু ওঠানামা দেখা গেলেও তা কোনো সময়েই ১৫০ টাকার বেশি হয়নি। নানা খাদ্যগুণে সমৃদ্ধ ও সুলভ মাছটি এখন দরিদ্রের পুষ্টিচাহিদা পূরণের অন্যতম বড় আধার।

নিম্ন আয়ের মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণের পাশাপাশি মত্স্য খামারিদেরও মুনাফার বড় উৎস হয়ে উঠেছে পাঙ্গাস। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মত্স্যখাদ্যের দাম বাড়ায় খামারিদের জন্য এ মুনাফা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

দেশে চাষকৃত মাছের বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে পাঙাশ। মত্স্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে চাষকৃত মাছ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ ৮৮ হাজার ৬০১ টন। এর মধ্যে শুধু পাঙাশই উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৪৭ হাজার টন। অর্থাৎ দেশে চাষকৃত মাছের প্রায় ১৮ শতাংশই পাঙাশ।

প্রায় দেড় দশক ধরে খামার ও পাইকারি পর্যায়ে মাছটির দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকার নিচে। বাজার বিশ্লেষক ও উৎপাদনে নিয়োজিত খামারিরা জানাচ্ছেন, ২০১০ সালের আগেও খামার থেকে প্রতি কেজি পাঙাশ মাছ ৫০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত খামার পর্যায়ে মাছটি ৫০-৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত পাঁচ বছর মাছটি ৬৫-৮৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি পর্যায়েও এক দশক ধরে মাছটির দাম ১০০ টাকার নিচেই রয়েছে। খুচরা বাজারেও প্রতি কেজি পাঙাশ পাওয়া যাচ্ছে ১৫০ টাকার নিচে।

বাজার ঘুরে দেখা গিয়েছে, বিক্রীত মাছগুলোর মধ্যে গড় দাম এখন সবচেয়ে কম চাষকৃত পাঙাশের। বাজারে বর্তমানে প্রচলিত অন্যান্য মাছের মধ্যে তেলাপিয়া বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৫০-১৭০ টাকায়। প্রায় একই দাম সিলভার কার্পেরও। রুই বিক্রি হচ্ছে ২২০-৩০০ টাকায়। প্রতি কেজি মৃগেলের দাম রাখা হচ্ছে ২০০ টাকার আশপাশে। কাতল মাছ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৮০-৩৫০ টাকায়। এছাড়া প্রতি কেজি পাবদা ৪৫০-৫০০ টাকা, কই ২০০, মলা ৩৫০, চাষের শিং ৪০০, মাগুর ৫০০ ও টেংরা মাছ ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

দামে কম হওয়ায় দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে পাঙাশের জনপ্রিয়তা বেশি। এ শ্রেণীর মানুষের পুষ্টিনিরাপত্তায় চাষকৃত মাছের মধ্যে এখন সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখছে পাঙাশ। মাছটির নানা খাদ্যগুণ এরই মধ্যে পুষ্টিবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রতি গ্রাম আমিষে অন্তত ২৭৭ মিলিগ্রাম অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকা উচিত। প্রতি গ্রাম পাঙাশে এ পুষ্টি উপাদান পাওয়া গিয়েছে ৪৩০ মিলিগ্রাম করে। ভারতের হায়দরাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশনের এক গবেষণায়ও দেখা গিয়েছে, চাষকৃত মাছের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড সবচেয়ে বেশি পাঙাশে।

অ্যামাইনো অ্যাসিডের উপস্থিতির মাত্রার ওপর আমিষের গুণমান নির্ভর করে বলে জানিয়েছেন পুষ্টিবিজ্ঞানীরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শারমিন রুমি আলীম বলেন, প্রোটিনের প্রথম শ্রেণীর উৎস হিসেবে মাছের মধ্যে সবসময়ই এগিয়ে রয়েছে পাঙাশ। পর্যাপ্ত অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকায় সবচেয়ে ভালো প্রোটিন পাওয়া যায় পাঙাশ মাছে। ওমেগা ও ভালো মানের ফ্যাট বা ফিশ অয়েল থাকার কারণে পাঙাশ হূদরোগেরও ঝুঁকি কমায়। মাছটির দাম কম থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষ সহজেই তাদের আমিষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে। দেশের একটি শ্রেণীর মানুষের পুষ্টিনিরাপত্তায় বড় অবদান রাখছে পাঙাশ মাছ।

একসময় দেশে পাঙাশের প্রধান উৎস ছিল নদী। সত্তরের দশক পর্যন্ত চাঁদপুরের মেঘনার পাঙাশ সরবরাহ হয়েছে সারা দেশে। কালের পরিক্রমায় নদী থেকে সুস্বাদু মাছটির আহরণ কমে যায়। মাছটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে চাঁদপুরের মত্স্য গবেষণা কেন্দ্রে থাই পাঙাশ আমদানি করা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই কৃত্রিম প্রজননে সফলতা পাওয়া যায়। সাফল্য পাওয়া যায় পরীক্ষামূলক বাণিজ্যিক চাষেও। এরপর দুই দশক ধরেই দেশের প্রধান চাষকৃত মাছ হয়ে উঠেছে পাঙাশ।

ওই সময়ে চাঁদপুরের জেলা মত্স্য কর্মকর্তা ছিলেন ড. সৈয়দ আরিফ আজাদ। পরবর্তী সময়ে মত্স্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দেশে পাঙাশের গবেষণা ও সম্প্রসারণে অন্যতম পুরোধা ধরা হয় তাকে। তিনি বলেন, কয়েক দশক ধরেই মাছটির বিপণন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী ও পেশার মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। অথচ পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ মাছটি সর্বসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করতে ব্যর্থ হয়েছি। মূল্য সংযোজন করে মাছটি উচ্চবিত্তদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি রফতানি বাজারে প্রবেশের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ দুটি ক্ষেত্রে সরকার ও বেসরকারি খাতের কোনো ধরনের কার্যকর উদ্যোগ নেই। পাশাপাশি নেতিবাচক প্রচারণা ও গন্ধের কারণে মাছটির চাহিদা বহুমুখী হচ্ছে না। অথচ অনেক দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে শুধু পাঙাশ।

পাঙাশ মাছকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে দেশের ফিড শিল্প। মাছটি উৎপাদনে বছরে প্রায় ছয় লাখ টন খাদ্যের প্রয়োজন হয়। সাম্প্রতিক সময়ে মত্স্যখাদ্যের দাম বাড়ায় খামারিদের জন্য মাছটির উৎপাদন ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছার মালতিপুর গ্রামে দুই দশক ধরে প্রাকৃতিক স্বাদযুক্ত পাঙাশ মাছ উৎপাদন করছেন মো. জহিরুল ইসলাম। পাশাপাশি রেণুও উৎপাদন করেন তিনি। কয়েক বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন মেসার্স একতা হ্যাচারি। পাঙাশ মাছ চাষের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, দুই দশক ধরেই এ অঞ্চলে চাষকৃত মাছে বিশেষ অবস্থান করে নিয়েছে পাঙাশ। তবে সম্প্রতি মাছ উৎপাদন কিছুটা কমছে। এতদিন দুই একরের বেশি জমিতে পাঙাশ মাছ চাষ করলেও চলতি বছর এক একর জমিতে করেছি।

তিনি আরো বলেন, মত্স্যখাদ্যের দাম বহুগুণ বাড়লেও মাছের দাম না বাড়ায় অনেকেই পাঙাশ মাছ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এজন্য অন্যান্য মাছে সরে যাচ্ছেন খামারিরা। একসময় রেণু উৎপাদন হাজার কেজির বেশি করলেও এখন তা ৩০০ কেজিতে নামিয়ে এনেছি। দাম না পাওয়ায় মুনাফাও তেমন একটা করতে পারছি না।

দেশে বাণিজ্যিকভাবে পাঙাশ চাষের বিষয়ে প্রথম পরীক্ষা চালায় বাংলাদেশ মত্স্য অধিদপ্তর। বেসরকারি পর্যায়ে সর্বপ্রথম ঢাকা ফিশারিজ ও আল-ফালাহ বাণিজ্যিকভাবে পাঙাশের চাষ শুরু করে। এ দুটি মত্স্য খামার ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও ভালুকা এলাকায় চাষ সম্প্রসারণ করে। এরপর নব্বইয়ের দশক থেকে থাই পাঙাশের চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্য অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক রিপন বলেন, মূলত রফতানি বাজার তৈরি করতে না পারা ও মূল্যসংযোজন না হওয়ার কারণেই পাঙাশ মাছটি শুধু নিম্নবিত্তদের খাদ্যপণ্য হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় দেড় দশক ধরেই মাছটির দাম ১০০ টাকার নিচে রয়েছে। সুলভ রাখতে হলে মাছের খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে হবে। পাঙাশ মাছে কাঁটা না থাকায় ফিলে করে বিদেশে রফতানির সুযোগ রয়েছে। এছাড়া মাছটিতে সবচেয়ে বেশি মূল্য সংযোজন করা সম্ভব। ফিশ ফিঙ্গার, বল, চপ তৈরি করে মূল্য সংযোজন করা সম্ভব। মাছটি চাষকৃত পুকুর থেকে তোলার পর অন্য পুকুরে অবমুক্ত রেখে শুদ্ধ পানিতে পরিষ্কার করে নিলে দুর্গন্ধমুক্ত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা দেশে চালু করতে হবে। এছাড়া মাছের ব্রুডের উন্নয়নে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গুণগত ও মানসম্পন্ন ব্রুড মাছ আমদানি করে বেসরকারি খাতে সরবরাহ করা যেতে পারে। - বণিক বার্তা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়