ভূঁইয়া আশিক রহমান : [২] বিশেষ সাক্ষাৎকারে গ্লোব বায়োটেকের কোয়ালিটি অ্যান্ড রেগুলেটরি অপারেশনের প্রধান ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, বঙ্গভ্যাক্সের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের লিখিত চিঠিপত্র এখনো পায়নি গেøাব বায়োটেক। ক্লিনিক্যাল অনুমোদনের জন্য যে ২টি শর্ত দিয়েছে বিএমআরসি, সেগুলো কী আমরা জানি না। কেননা আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো আমাদের জানানো হয়নি। গণমাধ্যমে এসেছেÑ ভারত ও চীনের পাশাপাশি শর্তসাপেক্ষে বঙ্গভ্যাক্সের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দেওয়া হবে।
[৩] এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে তিনি আরও বলেন, গত বছর লকডাউনে আমরা নিয়মিত অফিস করেছি, দিন-রাত এক করে কাজ করেছি। কারণ মহামারির মতো পরিস্থিতি কারও কাম্য ছিলো না। করোনার সংক্রমণ থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে চেষ্টার কমতি রাখিনি। অনেক পরিশ্রম করে আমরা ভ্যাকসিন নিয়ে এলাম, কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় এটি আটকে আছে, তা আসলে কারও কাম্য ছিলো না। তাহলে আমরা এতো কষ্ট কেন করলাম? ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন পেতে বিলম্ব হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে।
[৪] বঙ্গভ্যাক্সের ভ্যাকসিন আবিষ্কার আমাদের জন্য অনেক বড় এক ইতিহাস। এটা বাংলাদেশের কালচারে নতুন। এরকম একটা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা, পরে এটি এপ্রæভাল করার মতো প্র্যাক্টিস এখনো আমাদের এখানে গড়ে ওঠেনি।
[৫] খেয়াল করলে দেখবেন, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ফাইজার কাজ শুরু করেছিলো, মডার্না ফেব্রæয়ারিতে এবং অমরা মার্চে কাজ শুরু করেছিলাম। ফাইজার ডিসেম্বর ২০২০ সালেই মার্কেটে চলে এসেছে, সে হিসেবে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মার্কেটে আসার কথা ছিলো আমাদের। কিন্তু সেটি ঘটেনি।
কারণ বাংলাদেশে এ ধরনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। আমেরিকার কোম্পানিগুলোকে সরকার, এজেন্সিসমূহ সকলে একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আর আমাদের এখানে কী হচ্ছে, তা তো সকলেই দেখছেন। আমরা কি সকলের সহযোগিতা পাচ্ছি? প্রশ্ন রেখে গেলাম।
[৬] স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন সচিবের নেতৃত্বে ওষুধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গ্লোব বায়োটের গবেষণাগার পরিদর্শন করেছিলেন। তখন তারা একটা টেকনিক্যাল টিম গঠন করে দিয়েছিলেন বঙ্গভ্যাক্সের কার্যক্রম পর্যালোচনা করার জন্য। ওই টিম ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে দুইবার গেøাব বায়োটেকের গবেষণাগার পর্যবেক্ষণ করে সন্তোষজনক রিপোর্ট দিয়েছিলো স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়কে।
পরবর্তী সময়ে ওষুধ প্রশাসন একটি কমিটি গঠন করে দেয় বঙ্গভ্যাক্সের গবেষণাগার পরিদর্শন করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য, ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছিলো। অপর দিকে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের অধীনস্থ বিএমআরসিতে গত ১৭ জানুয়ারি ২০২১-এ আমরা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নৈতিক অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ৫ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও ট্রায়ালের নৈতিক অনুমোদন এখনো পাওয়া যায়নি।
[৭] ভেবেছিলামÑ ফাইজার বা মডার্নার চেয়েও কম সময়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন পেয়ে যাবো আমরা। কারণ আমরা যে প্রতিবেদনগুলো জমা দিয়েছি বিএমআরসিতে, সেখানে অনৈতিক কিছু আছে কিনা সেটি আগেই দেখা, নতুন করে দেখার কিছু ছিলো না। কারণ ইতোমধ্যেই এসব দেখেশুনে আমাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু কোথায় গিয়ে কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমরা এখন অসহায়। ক্লান্ত। অনুমোদনের অপেক্ষা আর শেষ হচ্ছে না!
[৮] বঙ্গভ্যাক্সের ব্যাপারে সরকার ও ওষধু প্রশাসন খুবই আন্তরিক। ডিসেম্বরের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি টিম পাঁচবার গেøাব বায়োটেকের গবেষণাগার ইনভেস্টিগেশন করেছে এবং প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। অন্য আরেকটি টিম ইনভেস্টিগেশন করে লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। ওষুধের যে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ওষুধ প্রশাসন, তারা কিন্তু টিকা তৈরির লাইসেন্সও দিয়ে দিয়েছে। এখানে তাদের কোনো আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু বিএমআরসি থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেনি বা করছে না।
[৯] বঙ্গভ্যাক্স নিয়ে আন্তর্জাতিক কোনো রাজনীতি হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। যদি এমন কিছু থেকে থাকে, তাহলে তা খুবই দুঃখজনক। এখানে আন্তর্জাতিক কোনো চাপ থাকার কথা নয়। আমাদের বাইরেও অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারাও বলছেনÑ এতোদিনেও অনুমোদন না পাওয়াটা দুঃখজনক।
[১০] ১৯৭২ সালে বিএমআরসি গঠনের সময় বলা হয়েছিলো যে, মেডিকেল অ্যান্ড হেলথ সায়েন্স রিসার্চে কোনো অগ্রগতি থাকলে সেটা চিহ্নিত করা এবং সেটার অগ্রাধিকার থাকবে। রিসার্চটিকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয় যায়, সেটি নিয়ে কাজ করা। এ বছরের জানুয়ারিতে আমাদের গবেষণাপত্র জমা দেওয়ার ৫ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো আমরা বঙ্গভ্যাক্সের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন পেলাম না, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজন।
[১১] বিএমঅরসি থেকে অযৌক্তিক কোনো শর্ত দেওয়া হলে আমরা কেন সেটা মেনে নেবো? অন্যান্য টিকা প্রতিষ্ঠান যে প্রক্রিয়ায় অনুমোদন চেয়েছে, অমরাও সেভাবে বিএমআরসিতে অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছি। আমরা যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করছি, ফাইজার, মডার্নাও একই পদ্ধতিতে আবেদন করে টিকা ট্রায়ালের অনুমোদন পেয়েছিলো। বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে। এখন আর কোনো প্রাণিকে মেরে ট্রায়াল করার প্রয়োজন হয় না। বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় বøাড নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
[১২] আমাদের আসলে দুর্ভাগ্য এখানে বিজ্ঞান এতোটা এগিয়ে যায়নি কিংবা অমরা বিজ্ঞান মনষ্কও নই। যে কারণে আমরা করোনা টিকা আবিষ্কার করেও, দেশ করোনায় বিপযস্ত থাকার পরও ট্রায়ালের অনুমোদন পাচ্ছি না।
[১৩] আমরা হতাশা। ক্ষতিগ্রস্ত। বঙ্গভ্যাক্স আমাদের আবিষ্কার। এ সম্পর্কে অবগত করতে একাধিকবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। সেই চিঠি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেয়েছেন কিনা আমরা জানি না। আমাদের সন্দেহ হয়, প্রধানমন্ত্রীকে কি সেই চিঠিগুলো দেওয়া হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের চিঠিগুলো পেতেন, অবশ্যই সাড়া দিতেন। কারণ তিনি জাতির জনকের কন্যা। যেকোনো আবিষ্কারে তার উৎসাহ ব্যাপক ও বিপুল। এছাড়া গেøাব বায়োটেকের ‘বঙ্গভ্যাক্স’ তো বাংলাদেশের গবেষকদেরই আবিষ্কার। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মানের। গৌরবের। সেই গৌরবের অংশীদার অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন।
[১৫] বঙ্গভ্যাক্সের ভ্যাকসিন হচ্ছে ভাইরাস মুক্ত। ভাইরাসের দেহ গঠন পরিবর্তন করতে পারে। যেটি করোনা ভাইরাসের মধ্যে আপনারা দেখেছেন। ওই ধরনের ভাইরাস টিকা যদি মানুষের শরীরে পুশ করা হয়, তাহলে তাদের মধ্যে অনেক বাজে প্রভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে।
[১৬] শুনে থাকবেন, টিকা নেওয়ার পর অনেকে স্বাভাবিক আচরণ করছেন না। কিন্তু বঙ্গভ্যাক্স জীবাণুমুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে। যে কারণে বঙ্গভ্যাক্সের কোনো পাশর্^প্রতিক্রিয়া হবে না বলে আমরা আশা করছি।