আসিফ আকবর: আমি থাকি ঢাকার মগবাজার এলাকায়। প্রতিদিন আমাকে ভিখারুন নিসা নুন সহ আরো কিছু স্কুলের জ্যাম ঠেলেই কাজে যেতে হতো। মাঝে মাঝে অসহ্য মনে হলেও বাচ্চাদের কলকাকলী খুব ভাল লাগতো। সবচেয়ে বেশি মজা লাগতো বাচ্চাগুলোর মায়েদের আড্ডা। স্কুলের আশেপাশে অবস্থান নিয়ে একটা সোসাইটি গড়ে উঠেছিলো। ওখান থেকেই ভাবীদের মধ্যে সখ্যতা আর ফাঁকে ফাঁকে বুটিক টাইপ ব্যবসাও প্রসার লাভ করেছিলো। কিছু ভাইদেরও বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেওয়া উপলক্ষ্যে ভাবীদের সঙ্গে হাহা, হিহি করতে দেখতাম! মোটামুটি স্কুলকে কেন্দ্র করে করে একটা উৎসব মুখর নয়েজ থাকতো।
এখন আর সেই উৎসব নেই। দীর্ঘদিন বাচ্চারা স্কুলে যায় না, যেন পৌরানিক সেই দৈত্যের ভয়ে বাগান ছেড়ে পালিয়েছে সবাই। কোথাও কোনো আনন্দ নেই। জেলখানার মতো স্কুলগুলোর প্রতি আগে খুব বিরক্ত ছিলাম। বাচ্চাদের খেলাধুলা এবং মেলামেশার সুযোগও ধ্বংস হয়ে গেছে। অনলাইন স্কুলের নামে বাচ্চাদের হাতে এখন এন্ড্রয়েট বোমা। ফোরজি স্পিডে ঘরকুনো জেনারেশন আরও একাকীত্বের শিকার হচ্ছে। তাদের মানসিক বিকাশে সমাজ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। শহরের চেয়ে গ্রাম মফস্বলে আরো দূরবস্থা। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। আমার আশেপাশেই নিয়মিত শুনি কর্মহীন মানুষের বোবা কান্না।
মগবাজারের সুউচ্চ বিল্ডিংগুলোর বাসিন্দা কমে গেছে। আবাসন ব্যবসায় ধ্বসের সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাট মালিকরা হারিয়েছে ভাড়াটিয়া। এর মধ্যে আমার বেগমও একজন, উনার ফ্ল্যাটেও টু-লেট ঝুলছে প্রায় ছয় মাস। যাদের ব্যাংক লোন আছে তাদের অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। প্রতিনিয়ত বাড়ছে গ্যাস পানি বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি চার্জ। মানুষের ইনকাম বাড়ছে না, পরিচিত বেকারদের ফোনে আমিই নিজেই স্বন্ত্রস্ত। পেপারে দেখলাম সুইস ব্যাংকে প্রচুর টাকা আমাদের, যদিও রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী রেমিটেন্সে টিকে আছে অর্থনীতি। কোথায় যেন পড়েছিলাম কমশিক্ষিত প্রবাসীরা শরীরের রক্ত ঘামে পরিণত করে দেশে টাকা পাঠায়, আর দেশের শিক্ষিতরা তাদের লুটপাট করা টাকা বিদেশে পাচার করে। কেমন যেন হয়ে গেছে ঢাকা, পুরো দেশটার অবস্থাই হয়তো এমন। চারিদিকে অশান্তির ঘনঘটা। এই দুর্যোগ কবে কাটবে কেউ জানে না। ভাইভাবীদের মধ্যে আবার আনন্দ ফিরে আসুক, বাচ্চারা মনের আনন্দে স্কুলে যাক। সর্বদা সরব এই ঢাকা শহরটা কেমন যেন ভৌতিক হয়ে গেছে। এই সময় সংঘাতের পথ ছেড়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে শিখুক মানুষ। আবার চিরপরিচিত কোলাহলে মুখরিত হোক মানুষের যাপিত জীবন। ভালোবাসা অবিরাম।