নিউজ ডেস্ক: মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বিপরীতে কর আদায়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তলানির দিকে। ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম। মূলত বিশাল অঙ্কের কর ছাড় এ জন্য দায়ী। ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বেসরকারি খাতে ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা কর ছাড় দিয়েছে। এ কর আদায় করা গেলে প্রকৃত কর-জিডিপি অনুপাত হতো ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। যা বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ। সম্প্রতি এনবিআরের সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সূত্র জানায়, কর-জিডিপি অনুপাতে পিছিয়ে থাকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা রকম সমালোচনা আছে। এ ক্ষেত্রে এনবিআরের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু প্রতি বছর যে পরিমাণ কর অব্যাহতি দেওয়া হয় এনবিআর তা আদায় করতে পারলে কর-জিডিপি অনুপাত দ্বিগুণ হতো। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতে প্রতি বছর নতুন নতুন শিল্পে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি এবং আমদানি পর্যায়ে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ তৈরি পোশাক খাতের কথা বলা যায়। রফতানি আয়ে বড় অবদান রাখা এ খাতের উন্নতির পেছনেও কর ছাড়ের অবদান রয়েছে। বন্ড সুবিধায় পোশাক খাতকে কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। আবার অন্য সব শিল্পের চেয়ে পোশাক শিল্পে করপোরেট করহার কম। অন্য দিকে সরকারের অবকাঠামো উন্নয়নে একাধিক মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব মেগা প্রকল্পের ব্যয় সহনীয় রাখতে যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক-কর ছাড় দেওয়া হয়। সূত্র আরও জানায়, বছরে কত টাকা কর ছাড় দেওয়া হয় তা জানতে এনবিআর নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা করে। এ সমীক্ষার ফলাফল বাজেটের আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। কোন খাতে কত ছাড় দেওয়া হয় তার বিস্তারিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এনবিআরের সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ, পণ্য আমদানির বিপরীতে ৪৬ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকার শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাকসহ রফতানিমুখী শিল্পে বন্ড সুবিধার বিপরীতে ছাড় দেওয়া হয়েছে আরও এক লাখ ৫১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ শুল্ক খাতে মোট এক লাখ ৯৮ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আয়কর ও ভ্যাট খাতে ছাড় দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মোট কর ছাড়ের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই লাখ ৪৮ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। খাতভিত্তিক কর ছাড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জিডিপিতে উৎপাদনশীল খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি।
এ খাতে সবচেয়ে বেশি কর ছাড় দেওয়া হয়। এর পরের অবস্থানে আছে যোগাযোগ; কৃষি, মৎস্য খাত; বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ; আবাসন; জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা; স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা; শিক্ষা খাতেও কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে পাঁচ বছরের কর-জিডিপি অনুপাতের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের তথ্য মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে কর-জিডিপির অনুপাত গড়ে ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ ছাড়া আইএমএফ-এর তথ্য অনুসারে জিডিপির অনুপাতে কর আদায়ের দিক থেকে ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫ নম্বরে। এ তালিকায় প্রথম অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ ফ্রান্স এবং সর্বনিম্নে কুয়েত। ফ্রান্স জিডিপির ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ কর আদায় করে। আর বাজেটের আকার জিডিপির ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারতের কর-জিডিপি অনুপাত ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ, নেপালের ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ, পাকিস্তানের ১৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। উদীয়মান ও উন্নয়শীল দেশগুলোর অনুপাত ২৪ দশমিক ৭২ শতাংশ এবং উন্নত দেশগুলোর অনুপাত ৩৫ দশমিক ৮১ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতি বিবৃতিতে বলা হয়, ১০ বছরে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বাড়ানো সম্ভব হয়নি। তাই রাজস্ব ব্যবস্থায় এ দুর্বলতা বিবেচনায় নিয়ে মধ্যমেয়াদে কার্যকর রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আয় বাড়ানোর জন্য নতুনভাবে কৌশল ও পরিকল্পনা জরুরি।
অবশ্য কর আদায়ের দুর্বলতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটের আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যত ধরনের কর ছাড় দেওয়া হয়, অন্য কোনো প্রতিবেশী দেশে তা দেওয়া হয় না। আমাদের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প ও মেগাপ্রকল্পসহ বিভিন্ন খাতের পণ্য আমদানিতে প্রচুর পরিমাণ কর ছাড় দেওয়া হয়। অন্য দিকে সরকারি হিসাবের এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে বুক ট্রান্সফার না করার দরুন অনাদায়ী ট্যাক্সের হিসাবও নেওয়া হয় না। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশীয় শিল্পে করছাড় দেওয়া হয়। এগুলো আদায় হলে আমাদের কর জিডিপি ১৪ থেকে ১৫ শতাংশে চলে যেত।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কর আদায় বাংলাদেশের অন্যতম দুর্বলতা। জিডিপির অনুপাতে অন্যতম খারাপ অবস্থানে বাংলাদেশ। আর এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। না হলে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এ অবস্থার উত্তরণের জন্য কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। পাশাপাশি করের জন্য নতুন খাত চিহ্নিত করা জরুরি। তার মতে, এখনো বিপুলসংখ্যক করযোগ্য মানুষ কর দেন না। তাদের চিহ্নিত করে, করের আওতায় আনতে হবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশের কর ব্যবস্থায় যে পরিমাণ ফাঁকি দেওয়া হয়, তা অন্য কোনো দেশে নেই। তিনি বলেন, কর ফাঁকি বন্ধ করতে পারলে রাজস্ব আদায়ে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সম্ভব। কিন্তু এ ধরনের ফাঁকি বন্ধে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা থাকা দরকার ছিল, এবারের বাজেটে সেই ধরনের পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
সূত্র: যুগান্তর