খালেকুজ্জামান: ১৮৮৬ আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কের্টে শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে এবং তদের মজুরি দাসত্বের মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছিলো। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানো হলে কয়েকজন শ্রমিক নিহত হয়। এরপর ২০২১ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে পুঁজিবাদী দুনিয়ায় শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পুরো পৃথিবীতে সবচেয়ে কম মজুরি দেওয়া বাংলাদেশের শ্রমিকদের। বাংলাদেশে এখনো ন্যূনতম মজুরি বলে কিছু নেই। আটঘণ্টা শ্রমঘণ্টা নামে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই। বাস্তবে ওভার টাইমের নামে শ্রমিকদের অনেক বেশি খাটানো হয়। তাছাড়া কাজের নিরাপত্তা, পরিবেশ, শ্রমিকাদের জীবন-মান উন্নয়ন ও ন্যায্য মজুরি বাংলাদেশে নেই।
বাংলাদেশের অঙ্গীকার ছিলো আমাদের দেশের শ্রমজীবী ও মেহেনতি মানুষের সার্বিক মুক্তিসাধন এবং তাদের কাজের যথাযোগ্য মর্যাদা এবং মজুরি। এই সময়কালে পুঁজিপতিশ্রেণির লোকেরা অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে। স্বাধীনতার পরে দুজন কোটিপতি থেকে এখন লক্ষ কোটিপতি তৈরি হয়েছে। ফলে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েছে। যখনই ধনী দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ে তখন সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। তার ফলে পরিবার থেকে সমাজে সর্বত্র সহিংসতা এবং নানা ধরনের অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভিত্তবানদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে গেলে জনগণ তখন ক্ষমতা বঞ্চিত হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে জনগণের ক্ষমতা দূরে থাক একটা নির্বাচন পর্যন্ত আমরা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করতে পারি না। এর মধ্যে ধনীরা আরও ধনী হয়ে যাচ্ছে, গবিরা আরও গরিব হচ্ছে।
সরকার তেল মাথায় আরও তেল দিচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি এই অবস্থাকে আরও বেশি ভয়াবহ করেছে। করোনার মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি লোক নতুন করে দরিদ্রের খাতায় নাম লিখিয়েছে। দেশে পূর্বে সাড়ে তিন হাজার কোটিপতি ছিলো এখন সেটা প্রায় দশ হাজার হয়েছে। এই অবস্থাটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের সঙ্গে যায় না। ফলে মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষায় ও চেতনার ভিত্তিতে যেই বাংলাদেশ গড়ে ওঠার কথা ছিলো সেই বাংলাদেশ এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি। সাধারণ মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন পূরণ হয়নি। একাত্তরে জীবন দিয়েছে এদেশের মেহনতি মানুষ ও শ্রমিকেরা। মে দিবসের তাৎপর্যকে মাথায় রেখে তাদের আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে।
পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছে বিভিন্ন কারখানা করার সঙ্গে সঙ্গে বাসস্থানের ব্যবস্থাও ছিলো। এখন বাংলাদেশে যে কারখানাগুলো হচ্ছে কোথাও সে রকম ব্যবস্থা নেই। ফলে শ্রমিকরা সুস্থভাবে জীবন-যাপন করা থেকে বঞ্চিত হেেচ্ছ। দেশের শ্রমিকরা যে নিম্ন মজুরি পায়, এতে করে তারা তাদের পরিবার নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যয়বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এই মানবেতর পরিস্থিতিতে খাটা-খাটনি করে গার্মেন্টস শ্রমিকরা অল্প বয়সে যারা কাজে যায় তারা শেষপর্যন্ত দীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারে না। সুস্থভাবে জীবন-যাপন করাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। কথায় কথায় শ্রমিকদেরকে চাকরিচ্যুত করা হয়। নানা-ভাবে মাস্তান, পুলিশ তাদের হয়রানি করা হয়। সবকিছু মিলিয়ে দেশের উন্নয়নের জন্য যে মানুষগুলো কাজ করছে সে মানুষগুলোর জীবন মান উন্নয়নের দিকে খেয়াল না রেখে পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার দিকেই সরকার ও কর্তৃপক্ষ। এটা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। সামাজিক বৈষম্য সমাজ থেকে দূর করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে একট সাম্য সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে। এছাড়া শ্রমিক শ্রেণি বা শ্রমজীবী মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন হবে না। শ্রমিকরাই হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারাই দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ। ৯৫ শতাংশ জীবন মান উন্নয়ন বাদ দিয়ে পাঁচ শতাংশ লোকের উন্নয়নের দেশের উন্নয়ন বলা একটি প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। ৯৫ শতাংশ মানুষের জীবন-মান উন্নয়নের ভিত্তিতে বাংলাদেশের উন্নয়নকে দেখতে হবে। ৫ শতাংশ মানুষের উন্নয়নকে দেশের উন্নয়ন বলার ধোকাবাজি বন্ধ করতে হবে। পরিচিতি: রাজনীতিবিদ। সাক্ষাৎকারের নিয়েছেন আমিরুল ইসলাম