আসাদুজ্জামান সম্রাট: আপনি শুধু শহরে নয়, দেশের যে প্রান্তে যাবেন গণপরিবহনে কোনো ভাড়া লাগবে না। হ্যা, সত্যিই পড়েছেন। পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ লুক্সেমবার্গে গণপরিবহণে কোনো ভাড়া গুনতে হয়না। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস, এস্তোনিয়ার ট্যালিন, ফ্রান্স ও পোল্যান্ডের কিছু শহরসহ বিশ্বের প্রায় শতাধিক শহরে বিনামূল্যে গণপরিবহন সেবা দেয়ার নজির থাকলেও, দেশব্যাপী এমন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে লুক্সেমবার্গই প্রথম। এ শহরেই গিয়েছিলাম ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের কনকনে শীতের মধ্যে। অপরূপ ল্যান্ডস্কেপের এই দেশটার শাসনব্যবস্থা যেমন নাগরিক বান্ধব তেমনি পরিবেশও।
লুক্সেমবার্গের সরকার মনে করে, বিনামূল্যে গণপরিবহন সেবা তাদের সামাজিক জীবনের মান বৃদ্ধিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ট্র্যাফিক জ্যামের জন্য বহুদিন ধরে নানা সমস্যায় ভুগতে থাকা লুক্সেমবার্গের সড়কগুলোতে প্রায় ৪৭% যাতায়াতই হতো ব্যক্তিগত গাড়িতে। বাসে যাতায়াতের পরিমাণটা সেখানে ৩২% ও ট্রেনের ক্ষেত্রে ১৯%। এতে শহওে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হতো এবং কর্মঘণ্টা নষ্ট হতো। এ থেকে বাঁচতেই এ ব্যবস্থা করছে সেদেশের সরকার। তবে ফার্স্ট-ক্লাস ট্রেনের যাত্রীরা বিনে পয়সায় এই সুবিধা পাবেন না। সেখানে তাদেরকে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। প্রাথমিকভাবে এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নে খরচ হবে ৪১ মিলিয়ন ইউরো, যা কি না পাউন্ডের হিসাবে ৩৫ মিলিয়ন ও মার্কিন ডলারের হিসেবে ৪৪ মিলিয়ন বাংলাদেশী প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। ছোট্ট এই দেশে এতো বিশাল অঙ্কের বাজেটের যথাযথ ব্যবহারের মধ্য দিয়েই নিশ্চিত করা হবে বিনামূল্যে ভ্রমণ সেবা। এক্ষেত্রে সরকার কোনো রকম ভর্তুকি দিচ্ছেনা। জনগণের ট্যাক্সের টাকাতেই হবে এই সেবার সকল ব্যবস্থা।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে যে সময়টিতে আমরা লু´েমবার্গে যাই তখন সামনে ক্রিসমাস। পুরো শহরে যেনো উৎসব শুরু হয়ে গেছে। শহরের প্রতিটি রাস্তায় অপরূপ লাইটিংয়ে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মনে হচ্ছে, পুরো শহরটিই যেনো একটি অভিজাত বিয়ে বাড়ি। অভিজাত হবেই বা না কেনো, ২০১৫ সালে জিডিপির ক্রমে গোটা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ ছিল লুক্সেমবার্গ। বিগত কয়েক দশক ধরে নাগরিক জীবনের সমৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি, দক্ষ দেশ পরিচালনায় লুক্সেমবার্গের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রযুক্তি ও আর্থিক সেবা শিল্পকে আরও বৈচিত্র্যময় করার মাধ্যমে দেশটি নিজেদের অর্থনীতিকে প্রতিনিয়ত আরও বেশি এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে চলেছে। দেশটিতে আছে ১৫৫টিরও বেশি ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, যাদের অধিকাংশই আবার বিদেশী মালিকানার। অসংখ্য ডেটা সেন্টার তৈরির মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নতিতে মাত্রাতিরিক্ত উচ্চ-গতিসম্পন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করায় গ্লোবাল কানেক্টিভিটির দিক থেকেও দেশটি আছে অনন্য উচ্চতায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, অপেক্ষাকৃত স্বল্প হারের কর্পোরেট ট্যাক্স, সুবিধাজনক ব্যবসায়িক পরিবেশ ও দক্ষ জনগোষ্ঠীই এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি।
বেলজিয়ামের মনির ভাইয়ের পুরো পরিবারসহ আমরা তিনজন উঠে বসলাম তার ওপেল গাড়িতে। প্রথমে এতো বেশি সংখ্যক মানুষ এই গাড়িতে কিভাবে বসবো তা নিয়ে চিন্তা ছিল আমার। কারণ আমার গাড়িতে ড্রাইভারসহ সর্বোচ্চ পাঁচজনের বসার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমরা ছিলাম ৬ জন। মনিরভাইয়ের ছেলে সাগর মোহাম্মদ গাড়ির পেছনের অংশ থেকে একটি বাটন টিপে একটি ফোল্ডিং সিট বের করলেন। এটি আবার এমনভাবে সেট করা যায় বোঝার কোন উপায় নেই। গাড়ি চালাচ্ছিলেন সাগরই। ও এই প্রথম লুক্সেমবার্গে যাচ্ছে গাড়ি ড্রাইভ করে। রাস্তা অপরিচিত। এজন্য জিপিএস চালু করে ফ্রন্ট উইন্ডোর সঙ্গে সেট করলেন। এই জিপিএস-এ কোথায় কোথায় গাড়ির গতি পরিমাপক রাড়ার আছে তা আগে থেকেই জানিয়ে দেয়। ফলে গাড়ির গতি বেশি থাকলে কমিয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে। কোন গাড়ির গতি বেশি থাকলে একটি ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে ছবি তোলা হয়। এজন্য কোনো লোক বসানো নেই। গতি বেশি হলেই অটো সেন্সর অন হয়ে ক্যামেরা চালু হয়ে ছবি তোলা হয়। গাড়ির ছবিসহ নাম্বার চলে যায় ট্রাফিক সিস্টেমের কাছে। সেখানেও অটো ফাইন হয়ে স্লিপ চলে যায় মালিকের বাসায় কিংবা ড্রাইভারের লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটা যায়। আমাদের সামনের বেশ কয়েকটি গাড়িকে এই ফ্ল্যাশ খেতে দেখলাম। সাগর বলছিলো, ওরা সম্ভবত জিপিএস ছাড়া গাড়ি চালাচ্ছে। জিপিএস চালু থাকলে সতর্ক হওয়ার অনেক সুযোগ থাকে।
আমরা তিন ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যেই লুক্সেমবার্গ শহরে পৌঁছে যাই। আমরা লুক্সেমবার্গ উচ্চারণ করলেও ওরা লাক্সেমমুর্গ উচ্চারণ করে। ছোট এই দেশের প্রতিবেশী দেশ জার্মানি, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম। আয়তন আড়াই হাজার বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি। জনসংখ্যা ৬ লাখ ৩০ হাজার। গড় আয়ু ৮২ বছরের কিছু বেশি। পাঁচ বছরের কমে শিশুমৃত্যুর ঘটনা দেশটিতে সবচেয়ে কম। ইউরোপের শহরগুলোর মতো লুক্সেমবার্গও ছবির মতোই সাজানো গোছানো। নতুন এবং পুরনো স্থাপত্যে মিলেমিশে এ শহর। শহরটি প্যারিস থেকে ৩৭২ কিলোমিটার, ব্রাসেলস থেকে ২১৩ কিলোমিটার এবং জার্মানির কোলন শহর থেকে ২০৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ফলে এই শহরে যারা চাকরি করেন তাদের বেশিরভাগই এই তিন দেশ থেকে আসে। প্রতিদিন এই দেশগুলোতে ২-৩ লাখ লোক যাতায়াত করে লুক্সেমবার্গে।
লুক্সেমবার্গ শহরে ঢুকে আমরা প্রথমেই সমস্যায় পড়ি গাড়ি পার্কিংয়ের। গাড়ি পার্কিং করার জন্য জায়গা পেলেও পেমেন্ট করার জন্য বক্সে কয়েন ডুকানোর পরে তা বার বার বের হয়ে আসছিল। পরে এক ভদ্রলোকের সাহায্য নিয়ে এ্যাডলফ ব্রিজের আগেই একটা জায়গায় পার্কিং করা গেছে। বিকেল চারটা বেজে যাওয়ায় আর পার্কিং চার্জ দিতে হবেনা বলে তিনি জানান। এই এডলফ সেতুর শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সেতু। নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯০০ সালে। ১৯০৩ সালে তা সমাপ্ত হয়ে ওই বছরের ২৪ জুলাই জনগণের যাতায়াতের জন্য খুলে দেয়া হয়। উচু নিচু পাহাড়ের শহর লুক্সেমবার্গের এই সেতুটি মূলত শহরের দুটি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করে মূল সড়কে পরিণত হয়েছে। এটির সবচে’ বড়ো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ১৩৮ ফুটের গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স। এর সবচে’ বড়ো স্প্যানটির দৈর্ঘ্য ২৭৭ ফুট। ৫০২ ফুট দীর্ঘ এই সেতুর প্রস্ত হচ্ছে ৫৬ ফুট। এর নিচ দিয়ে বয়ে চলছে পিত্রুসি নদী। এটিকে অবশ্য নদী না বলে খালই বলা যায়। আমাদের বরিশাল অঞ্চলের খালগুলো এর চেয়ে বড়ো হয়। ফ্রেঞ্চ স্থপতি পল শ্যোগ্রে এবং লুক্সেমার্গের স্থপতি অ্যালবার্ট রডাজ এটি নির্মাণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার ওয়ালনাট লেন সেতুর অনুকরণে তৈরি হয়েছিল এই গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি।
এই সেতুর উত্তর পাড়ে গাড়ি পার্কিং করে একটি রেষ্টুরেন্টে ডুকে পড়লাম কিছু খাওয়ার জন্য। রেষ্টুরেন্টে অর্ডার দেবো এমন সময় তিনজন মধ্যয়স্কা নারী ঢুকলো কুকুর নিয়ে। ওয়েটার কুকুরের জন্য খাবার দিলো সুসজ্জিত একটা বাটিতে। কুকুরকে রেষ্টুরেন্টে খাওয়ানোর জন্য এমন সুন্দর ব্যবস্থা আমি আর কোথাও দেখিনি। অনেক রেষ্টুরেন্টে কুকুর নিয়ে ডুকতে দেয়া হয়না। এমন সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকে। তিনটি কুকুর পাশাপাশি খেলেও কোনো শব্দ নেই। কেউ কারোটা নিচ্ছেনা। লুক্সেমবার্গের মানুষের মতো এরাও বেশ ভদ্র। আমাদের দেশে তো কামড়া-কামড়ি একটি জাতীয় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে কুকুরের পাশাপাশি বসে খেতে আমার আপত্তি না থাকলেও মনির ভাইয়ের স্ত্রীর বেশ আপত্তি ছিল। তিনি দ্রুতই রেষ্টুরেন্টের বাইরে চলে গেলেন। আমরাও তাকে অনুসরণ করলাম।
এরপর শুরু হলো পদব্রজে লুক্সেমবার্গ দেখা। ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে পুরো লুক্সেমবার্গের সাজ সাজ রব ছিল অন্যরকম। যেদিকে তাকাই চোখ ফেরানো যায়না। সামনেই পড়লো নটরডেম ক্যাথেড্রাল। আমরা যে এডলফ সেতুর কাছে গাড়ি পার্কিং করেছিলাম সেখান থেকে ক্যাথিড্রালটি দেখতে বেশ সুন্দর লাগে। লুক্সেমবার্গ শহরের দক্ষিণে কনস্টিটিউশন স্কয়ারের পাশেই অবস্থিত প্রাচীন এই গির্জাটি। এর একপাশে জেলে ফ্রাঁ স্মৃতিসৌধ এবং অন্যপাশে লুক্সেমবুর্গ সলিডারিটি মনুমেন্ট। স্থানীয় ভাষায় নত্রদাম ক্যাথিড্রালটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৬১৩ সালে। তবে পুরনো ক্যাথিড্রালটি ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে সম্প্রসারণ করা হয়। গথিক স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শনটি এই ক্যাথিড্রাল। লুক্সেমবার্গ শহরের একমাত্র রোমান ক্যাথলিক গির্জা এই নত্রদাম ক্যাথিড্রাল। নত্রদাম ক্যাথিড্রালের প্রবেশমুখে দৃষ্টিনন্দন পাথরের ভাস্কর্য। এর ভেতর-বাইরে এরকম আরো অনেক ভাষ্কর্য আছে। নত্রদাম ক্যাথিড্রালের ভেতরে রয়েছে সুবিশাল প্রার্থনা কক্ষ। ভেতরের স্থাপত্যিক বৈশিষ্টও বেশ আকর্ষণীয়। নত্রদাম ক্যাথিড্রালের চারপাশ জুড়ে আছে রঙিন কাঁচে আঁকা নানান শিল্পকর্ম। এছাড়াও অনেক মূল্যবান প্রাচীন চিত্রকর্ম টাঙানো আছে গির্জাটির ভেতরের দেয়ালে। সব ধর্মের নারী-পুরুষই নত্রদাম ক্যাথিড্রালের ভেতরে যেতে পারেন। পুরো গির্জাই ঘুরে দেখার সুযোগ আছে পর্যটকদের। লুক্সেমবার্গ শহরে বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যের মধ্যে নত্রদাম ক্যাথিড্রাল অন্যতম। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের ভিড় থাকে জায়গাটিতে। আমি এর বাহ্যিক সৌন্দর্যেই বেশি মুগ্ধ হয়েছি। কয়েকটি সেলফি তুলে চলে গেলাম গোল্ডেন লেডি চত্বরে। সেখানে ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে মেলা বসেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও কোরিয়ান যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসোধ এই গোল্ডেন লেটি। লুক্সেমবার্গ শহরের ভিল হাউটের কনস্টিটিউশন স্কয়ারে আবস্থিত এই সৌধটিকে স্থানীয়রা জেলে ফ্রাঁ নামে চেনে। লুক্সেমবার্গের ভাষায় জেলে ফ্রাঁ মানে গোল্ডেন লেডি। প্রায় ২১ মিটার উঁচু এই স্মৃতি স্তম্ভটির উপরে আছে সোনায় তৈরি এ গোল্ডেন লেডি ভাস্কর্যটি। বড়দিন উপলক্ষ্যে এই চত্বরে মেলা বসেছে। নানা ধরনের খাবারের দোকান ছাড়াও নারীদের প্রসাধনী, অলঙ্কার এবং বাচ্চাদের জন্য খেলনার বিভিন্ন রাইড রয়েছে। আমি এমন একটি সার্কেলে উঠে পড়লাম। উদ্দেশ্য উপর থেকে লুক্সেমবার্গ শহরকে দেখা। পাখির চোখে লুক্সেমবার্গ অন্যরকম এক সৌন্দর্যের শহরও বটে। আমরা মেলা থেকে বিভিন্ন স্যুভেনির কিনলাম। এখানকার খাবারের দোকান থেকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কেক ও কফি খেয়ে পেটপুজা করলাম। এর পাশেই ক্যানন হিলে গেলাম লুক্সেমবুর্গ সলিডারিটি মনুমেন্ট দেখতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত এবং নাৎসি দখলদারদের মুখোমুখি লুক্সেমবুর্গ জাতির একাত্মতার স্মরণে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধটি। সেখানে কয়েকটি ছবি তুলে একটি দুর্গের দিকে রওয়ানা দিলাম।
আমরা যখন ভ্রমণ করি তখন বহুমুখী সংস্কৃতির এই দেশটি বিশ্বের সবচে’ ধনী রাষ্ট্র ছিল। বর্তমানে সে মর্যাদা হারিয়েছে তারা। বর্তমানে বিশ্বের তিন নম্বর ধনী দেশ হচ্ছে লুক্সেমবার্গ। এখানকার সবচে’ বড়ো বৈশিষ্ট হচ্ছে, এটি একটি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্টেট। সামাজিক সুরক্ষাগুলো অভাবনীয়। ফলে একদিকে যেমন বেকারত্ব নেই। ঠিক তেমনি নেই দারিদ্রতাও। ছোট এই দেশে ১৪০টির বেশি ব্যাংক রয়েছে। ফলে অনেকে এটিকে ব্যাংকের শহরও বলে থাকে। ধনী রাষ্ট্র হওয়ায় এর জীবনযাত্রার মান ও ব্যায় দুটিই আকাশচুম্বী। ফলে এখানে বাংলাদেশীর সংখ্যা হাতে গোনা। এই শহরে কোনো বাংলাদেশী খোঁজার চেষ্টাও আমরা করিনি। লুক্সেমবার্গের অর্থনীতি পূর্বে ইস্পাত এবং শিল্পখাতের ওপর নির্ভরশীল হলেও বর্তমানে ব্যাংকিং নির্ভর। বিশ্বের অন্যতম সব বড় বড় কোম্পানির হেড কোয়ার্টার এইখানে। এখানে প্রবাসী নাগরিকরা চাকরি হারালেও তাদের জন্য সরকার থেকে ভাতা দেওয়া হয়। এইখানে প্রায় বিশ্বের সব দেশ থেকেই শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে। রিসার্চ বেইসড পড়াশোনা এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধশালী করেছে। লুক্সেমবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের ৪১৪টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১২ এবং সহস্রাব্দ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চতুর্থ স্থান অর্জন করে। উন্নত দেশের মতো এখানে চিকিৎসা সেবার মানও অনেক উন্নত। প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যবীমা বাধ্যতামূলক। জিডিপির সাত ভাগ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা হয় যা ৪.১ বিলিয়ন ডলার, শুধুমাত্র ৬.৩ লাখ মানুষের জন্য। একটি দেশের উন্নতি অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করলে লুক্সেমবার্গের মতো আর কোনো দেশ নেই।
আমরা দ্রুতই চললাম দ্য বক কাসেমেন্টস দেখতে। এটি পাথরের তৈরি এক আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার হাত থেকে প্রায় ৩৫ হাজার লোকের জীবন বাঁচাতে ব্যবহার করা হয়েছিল। শুধুমাত্র লুক্সেমবার্গ শহরেই নয়, সারা দেশে এমন অসংখ্য দুর্গ রয়েছে। ছবির মত সুন্দর এই শহর প্রায় ১০০ দুর্গ দিয়ে ঘেরা। ১৮৩৯ সালে দেশটি সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়া লুক্সেমবার্গ ৯৬৩ সালে প্রথম দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল। বেশিরভাগ দুর্গ দেশের উত্তর দিকে অবস্থিত; তিনটি বৃহত্তম দুর্গ হল ভায়েনডেন, ক্লারভাক্স এবং বোর্সচেডে। বিভিন্ন দুর্গে নগরী ঘিরে রয়েছে ভূগর্ভস্থ টানেল যা প্রতিরক্ষার স্বার্থে ১৬০০ সালে নির্মিত হয়েছিল। এজন্য দুর্গের দেশ নামেও পরিচিতি রয়েছে ছোট এ দেশের।
সময় স্বল্পতার জন্য দেখতে পারিনি লুক্সেমবার্গের প্রধান রেল স্টেশনটি। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা গল্প শুনেছি। লুক্সেমবার্গ শহরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত প্রধান রেল স্টেশনটি নাকি কাঠের তৈরি। যেটি তৈরি হয়েছিল ১৮৫৯ সালে। তবে বর্তমানের স্টেশন ভবনটি তৈরি হয় ১৯০৭-১৯১৩ সালে। এর স্থপতি ছিলেন তিন জার্মান স্থপতি ব্যুডেল, ইয়্যুসগেন এবং শয়ফেল। আরও যাওয়া হয়নি গ্র্যান্ড ঢুকাল প্যালেসে। এটি নাকি পৃথিবীর সবচে’ সুন্দর প্যালসগুলোর একটি। লুক্সেমবার্গের শহরতলীর একটি চেইন শপ থেকে নিজের দোকানের জন্য পানীয় কেনার জন্য গেলেন মনির ভাই। সেখানে প্রতিটি পানীয় টেস্ট করার জন্য ফ্রি খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমি একটু ওয়াইনের টেস্ট নিলাম। কিন্তু সহকর্মী এক বন্ধু এতোটাই খেয়েছিল সে ঠিকমতো হাটতেও পারছিলনা। লুক্সেমবার্গ থেকে ব্রাসেলসের পুরো পথটিতেই তিনি ঘোরের মধ্যে ছিলেন।
মনির ভাইয়ের এই পানীয় কেনার মাজেজাটা পরে বুঝেছিলাম। এই দেশকে ট্যাক্সের স্বর্গ দেশ বলা হয়। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ব্যবসা করলে অনেক ট্যাক্স বা কর দিতে হয়, কিন্তু লুক্সেমবার্গে ঠিক উল্টো। এজন্যই অনেক কোম্পানির সদর দপ্তর এই দেশে অবস্থিত। লুক্সেমবার্গে পাঁচ ধরণের বিয়ার তৈরি করা হয়- মাউসেল, ব্যাটিন, ডেইকির্চ, বোফফার্ডিং এবং সাইমন। এগুলো সমগ্র লুক্সেমবার্গ জুড়েই বহুল জনপ্রিয়। দেশের চাহিদা বিবেচনা করে প্রচুর ওয়াইন উৎপাদন করা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, উৎপাদিত বেশিরভাগ ওয়াইন হল সাদা ওয়াইন এবং স্পার্কলিং ওয়াইন, যা ক্রেম্যান্ট নামে লুক্সেমবার্গে পরিচিত। পাশাপাশি রয়েছে কিছু প্রিমিয়াম ওয়াইন। লুক্সেমবার্গে এমন কিছু পানীয়ও তৈরি হয় যা সাধারণত ইউরোপের সব জায়গায় পাওয়া যায়; যেমন মীরাবেল এবং কিরশের। রাজধানীর উত্তর-পূর্বে এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে রয়েছে বউফোর্টের দুর্গ। যেখানে গাঢ় কালো রঙের অ্যালকোহল তৈরি কর হয় যা লুক্সেমবার্গের লোকেরা খুব পছন্দ করে। লুক্সেমবার্গের গিনেজ বুক রেকর্ডে নাম ওঠানো সেরা রেস্তোরার নাম ‘সিগ্যারী’তে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওয়াইন কালেকশন। ১৭৪৬ ধরনের ওয়াইন প্রস্তুত রয়েছে পর্যটকদের তৃষ্ণা মেটাতে।
ট্যাক্স হ্যাভেনের এই দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার কারনেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রকৃত পাওয়ার সেন্টার হিসেবে নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস, ইউরোপিয়ান কোর্ট অব অডিটরস, দ্য সেক্রেটারিয়েট অব দ্য ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড এই দেশে কেনো এসেছে তার হিসাব মেলাতে মেলাতেই আমরা ব্রাসেলসে পৌছে যাই। পেছনে পড়ে রইলো ছবির মতো সুন্দর একটি দেশ দেখার মধুময় স্মৃতি।
লেখক: আসাদুজ্জামান সম্রাট, নগর সম্পাদক-দৈনিক আমাদের অর্থনীতি ও সম্পাদক-পার্লামেন্ট জার্নাল