ডেস্ক রিপোর্ট: রাত তখন সোয়া তিনটা। পুরান ঢাকার আরমানিটোলার মসজিদ থেকে ভেসে আসছিল মুয়াজ্জিনের ডাক, ‘সাহ্রি খাওয়ার সময় হয়েছে। আপনারা ঘুম থেকে উঠুন।’
বাহার আহমেদ মসজিদের মাইকের শব্দ শুনে ঘুম থেকে ওঠেন। আরমানিটোলার হাজি মুসা ম্যানশনের পাশে নির্মাণাধীন ১৪ তলা ভবন মক্কা টাওয়ারে বাস করেন তিনি। ঘুম ভাঙার পরই পাশের ভবন থেকে মানুষের চিৎকার তাঁর কানে আসে। বাসিন্দারা বলছিলেন, ‘আগুন লেগেছে, আমাদের বাঁচান।’
সঙ্গে সঙ্গে নিচে নামেন বাহার। দেখতে পান, মুসা ম্যানশনের নিচতলায় আগুন জ্বলছে। সেখানে রাসায়নিকের দোকান। ভবনের দুই থেকে ছয়তলা পর্যন্ত ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা সাহায্য চেয়ে চিৎকার করছেন। ততক্ষণে চলে আসে ফায়ার সার্ভিস। তাঁদের একদল কর্মী রাসায়নিকের দোকানের আগুন নেভাতে থাকেন। আরেক দল মক্কা টাওয়ারের বাসিন্দা বাহার আহমেদসহ কয়েকজনকে নিয়ে মুসা ম্যানশনে আটকে পড়া ব্যক্তিদের বাঁচাতে তৎপর হন।
আরমানিটোলায় গত শুক্রবার ভোররাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৮০ জনের মতো মানুষকে উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও স্থানীয়রা। এ ক্ষেত্রে তাঁদের সহায়তা করেছে মক্কা টাওয়ারের নির্মাণকাজে ব্যবহৃত দুটি মই। মুসা ম্যানশনের জানালার গ্রিল কেটে এই মই দিয়েই বাসিন্দাদের বড় অংশকে পাশের ভবনে সরিয়ে নেওয়া হয়। মই দুটির একটি লোহার তৈরি, অন্যটি বাঁশের। লম্বা একেকটি ১২ ফুটের মতো।
বাহার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মই দুটি না থাকলে প্রাণহানি আরও বেশি হতে পারত।’
এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়। চিকিৎসাধীন আরও ১৪ জন। গত রোববার মুসা ম্যানশনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের বেশির ভাগ জানালার গ্রিল কাটা। উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া মক্কা টাওয়ারের কর্মী মো. হেলাল বলেন, আটকে পড়া বাসিন্দাদের উদ্ধার করতে মক্কা টাওয়ারের একেকটি তলা থেকে মই লাগিয়ে মুসা ম্যানশনের জানালার গ্রিল কাটা হয়। ফায়ার সার্ভিসের কাছে গ্রিল কাটার সরঞ্জাম ছিল।
মুসা ম্যানশন আর মক্কা টাওয়ারের দূরত্ব আট ফুটের মতো। ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধারে অংশ নেওয়া স্থানীয়রা জানান, ফায়ার সার্ভিসের একটি যান্ত্রিক সিঁড়ি দিয়েও আরেক পাশ থেকে কিছু মানুষকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার তৎপরতায় সরাসরি অংশ নেন ফায়ার সার্ভিসের সদরঘাট স্টেশনের কর্মকর্তা আবু সায়েম। তিনি বলেন, উদ্ধারকাজ দ্রুত করা না গেলে বিষাক্ত ধোঁয়ায় প্রাণহানি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও চিকিৎসকদের তথ্য বলছে, আরমানিটোলার আগুনে যে পাঁচজন মারা গেছেন, তাঁদের দেহে পোড়ার ক্ষত ছিল না।
মুসা ম্যানশনের নিচতলায় ১৮টি রাসায়নিকের দোকান ছিল। ভবনের মালিক মোস্তাক আহমেদ চিশতী পরিবারসহ ধানমন্ডিতে থাকেন। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বংশাল থানায় মামলা করে। মামলায় এজাহারভুক্ত দুই আসামি মোস্তাফিজুর রহমান ও মোহাম্মদ মোস্তফাকে গতকাল গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। ভবনটিতে দুজনেরই রাসায়নিকের দোকান রয়েছে।
আরমানিটোলা পুরান ঢাকার রাসায়নিক ব্যবসার মূল কেন্দ্র। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, দুই বছর আগে চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ আগুনে ৭১ জনের মৃত্যুর পর তাঁরা আশা করেছিলেন, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম পরিকল্পিত এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হবে। তবে তা হয়নি।
আরমানিটোলার ঘটনায় মারা যাওয়া তরুণ শাফায়াত হোসেনের চাচি হোসনে আরা বলেন, পুরান ঢাকা থেকে সব রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নেওয়া হোক। আর কাউকে যেন মরতে না হয়। প্রথম আলো