আর রাজী, ফেসবুক থেকে, আমাদের উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে ‘রিপাবলিক’ শব্দটাকে স্বভাষায় উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সকলে একমত নয়। যেমন ইন্ডিয়ার আনুষ্ঠানিক নাম ইংরেজিতে ‘রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া’, হিন্দিতে ‘ভারত গণরাজ্য’ কিন্তু বাংলায় ‘ভারতীয় প্রজাতন্ত্র’। আমরা আগেই দেখেছি, ‘রিপাবলিক’ শব্দটার মধ্যে ‘প্রজা’ যেমন নাই তেমনি নাই ‘তন্ত্র’ শব্দটাও। হিন্দিতে ‘ভারত গণরাজ্য’ করার সময় এই ব্যাপারটি সম্ভবত হিন্দিকর্তাদের নজরে ছিল কিন্তু বাংলায় সেটি রক্ষা হয়নি।
শ্রীলঙ্কার নাম হচ্ছে ‘ডেমোক্রেটিক সোসালিস্ট রিপাবলিক অব শ্রীলঙ্কা’। সিনহলি ভাষায় তারা বলে, ‘শ্রীলঙ্কা প্রজাতান্ত্রিক সমাজবাদী জনরাজ্য’ আর তামিল ভাষায় বলে ‘ইলাংগাই সেনানায়কা সোসালিসা কুড়িআরাসু’। তারা ‘ডেমোক্রেটিক’-এর সিনহলি করেছে ‘প্রজাতান্ত্রিক’ আর রিপাবলিকের সিনহলি (অর্থ) করেছে ‘জনরাজ্য’। (ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক/ প্রজাতান্ত্রিক জনরাজ্য)। আর ‘ডেমোক্রেসি’র তামিল করেছে ‘সেনানায়কা’ (জননায়কা) ও রিপাবলিকের তামিল করেছে ‘কুড়িআরাসু’ (কুড়িয়া রাজ্য)। এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে গ্রিসের নামের কথা, যে গ্রিস ‘রিপাবলিক’ শব্দের সমার্থক হিসেবে জেনেছে ‘ডেমোক্রেসি’ শব্দটাকে।
পাকিস্তান হচ্ছে ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান, ইসলামি জুমহুরিয়া পাকিস্তান। আরেক সার্ক দেশ মালদ্বীপের নাম হচ্ছে, রিপাবলিক অব মালদ্বীপ (ডিভেহি রাজ্যেইগে জুমহুরিয়া)। অনেক বোদ্ধাই বলেছেন, ‘জুমহুরিয়া’ এমন এক আরবি শব্দ যার ইংরেজি বা বাংলা করা প্রায় অসম্ভব। তবে সাধারণভাবে ‘জুমহুরিয়া’ শব্দটা ‘বহুজনের রাষ্ট্র’ (স্টেট অব দ্যা ম্যাসেস) বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যার একটি সরল ইংরেজি হচ্ছে রিপাবলিক।
ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব নেপাল, তাদের নেপালী নাম রেখেছে “সংঘেয় লোকতান্ত্রিক নেপাল”। ‘ফেডারেল’ শব্দকে তারা বুঝেছে ‘সংঘ’ হিসেবে, আর ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক’কে তাদের ভাষায় রূপান্তর করেছে ‘লোকতান্ত্রিক’ হিসেবে। বাংলাভাষার কাছাকাছি ধরনের হওয়ায় আমরা সহজেই বুঝতে পারছি নেপাল কতোখানি জনবোধ্য ও অর্থবহভাবে তার রাষ্ট্রের নামকরণ করেছে।
যাই হোক, রিপাবলিক-এ ধারণা ইন্ডিয়ার স্বভাষায় হয়েছে গণরাজ্য, শ্রীলঙ্কা তামিল ভাষায় রিপাবলিককে বুঝেছে জননায়কের রাষ্ট্র হিসেবে, পাকিস্তান রিপাবলিককে বুঝেছে জামহুরিয়া বা সংখ্যাগরীষ্ঠ শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে, মালদ্বীপও বুঝেছে জামহুরিয়াত বা সংখ্যাগরীষ্ঠ শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে, নেপাল তার ভাষায় রিপাবলিককে বলেছে লোকতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দক্ষীণএশীয় দেশগুলোর মধ্যে কেবল বাংলাদেশ ‘রিপাবলিক’-এর বাংলা করেছে ‘প্রজাতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র। আমাদের এই দক্ষিণএশিয় দেশগুলো (ভুটান বাদে) নিজেদেরকে ‘রিপাবলিক’ বলে এবং তারা যখন স্বভাষায় সেই নামটি লেখে তখন তাতে “প্রজা” ধারনার কোনো ছাপ পাওয়া যায় না।
কমিউনিস্টরা ক্ষমতা নেওয়ার আগে চীনের নাম ছিল ‘রিপাবলিক অব চায়না’। কমিউনিস্টরা ক্ষমতা নেওয়ার পর ইংরেজিতে হয় ‘পিউপলস রিপাবলিক অব চায়না’, চৈনিক ভাষায় Zhōnghuá Rénmín Gònghéguó (中华人民共和国)। অনুমান করি, চীনের বিপ্লবী সরকার চীনক জনগণের মালিকানাকে জোর দিয়ে বোঝাতেই ‘রিপাবলিক’-এর আগে আবার Rénmín বা ‘পিউপিলস’ ব্যবহার করেছে, যদিও Gònghéguó বা রিপাবলিক-এর মধ্যেই জনগণ মালিকানার ব্যাপারটি অন্তঃস্থ রয়েছে। সম্ভবত চীনের এই ‘বৈপ্লবিক ভূমিকা’ বাংলাদেশের নাম করণে ভূমিকা রেখেছে এবং আমরাও রিপাবলিকের আগে পিউপলস যোগ করে নিয়েছি এবং তার বাংলা করতে গিয়ে ‘গণপ্রজা’র মতো এমন একটা নতুন ভাবপ্রত্যয় তৈরি করেছি যেখানে ‘রিপাবলিক’ অর্থ যে ‘লোকের সম্পদ’ সেটিই হারিয়ে গেছে এবং দেশের মালিকদের প্রজায় অধঃপতন ঘটেছে।
ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ- এরা বাংলাদেশের থেকে প্রবীণ ‘রিপাবলিক’, নেপাল নবীন; কিন্তু নবীন বা প্রবীণের কেউই নিজেদের রিপাবলিকের সাথে ‘প্রজা’ প্রত্যয়টির সম্পর্ক দেখতে পায়নি। তাহলে বাংলাদেশের বাংলাভাষীরা কীভাবে বা কেন রাষ্ট্রটির নামের সাথে ‘প্রজা’ যুক্ত করলো? সেই আলোচনা আগামী পর্বে।