পুলক ঘটক: ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের এই এপ্রিলের ব্যবধান ৮ বছর। এই আট বছর যাবৎ তিনি ফৌজদারি অপরাধের আসামি। অথচ তিনি মনেও করেননি একবার আদালতে যাওয়া উচিত; মামলা যেহেতু আছে, অন্তত জামিন নেওয়া উচিত। আমি হেফাজতের নেতা মামুনুল হকের কথা বলছি। তার মানে কি এই আট বছর যাবৎ তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন? পুলিশ তার হদিস খুঁজে পায়নি? মোটেই নয়। পুলিশ বরং তাকে বিভিন্নভাবে প্রটোকল দিয়েছে। খালি মামুনুল হক নয়, হেফাজতের অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। তাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, কিন্তু তারা আইন আদালতের পরোয়া করেন না, কোনো কিছুর তোয়াক্কা নেই। এর মাঝেই হেফাজত নেতারা অনেকবার দেখা করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয়ে থাকেন। তার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে আইনের চোখে আসামি বা পলাতক ব্যক্তিবর্গের। কোনো স্পেশাল ইনডেমনিটির আওতায় এসব সম্ভব হলো? এ আজব ব্যাপার!
মামুনুলকে গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার হারুন অর রশিদ একাত্তর টিভিতে বলছিলেন, ‘তার নামে অনেক মামলা।... তাকে অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। অনেক বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে।’ আচ্ছা, কারও নামে ফৌজদারি মামলা থাকলে পুলিশের কি তাকে বুঝানোর বা ছাড় দেওয়ার সুযোগ আছে? পুলিশ কি চাইলেই যাকে ইচ্ছা ছাড় দিতে এবং যাকে ইচ্ছা টাইট দিতে পারে? এটা কি পুলিশের চাকরি? পুলিশের এই বক্তব্য বা এ ধরনের কর্মকাণ্ড কি আইনানুগ? কিন্তু আমি হারুন সাহেবকে দোষ দেবো না। কারণ তিনি যতো বড় কর্মকর্তাই হন, তার কি ক্ষমতা আছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে অ্যাকশন নেওয়ার? সত্য ঘটনা হচ্ছে, সরকারের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের একটা রাজনৈতিক আঁতাত ছিলো। সরকারের হেফাজতে থেকেই এই তালেবানরা বেড়ে উঠেছে। তাদের সকল প্রকার সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, মানুষ হত্যার ফতোয়া দান, দণ্ডিত জঙ্গিদের মুক্তি দাবি করাসহ সকল প্রকারের সন্ত্রাসমূলক বক্তব্যবিবৃতি সরকারের ছাঁয়ায় থেকেই হয়েছে। এই ছাঁয়াদানের কাজটি করেছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। যারা সবসময় বলে এসেছে ‘সামরিক শাসকদের হাত ধরে এদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।’ আমরা দেখছি সেই আওয়ামী লীগের হাত ধরে মৌলবাদ নয়, উগ্র মৌলবাদ দেশের ওপর জেঁকে বসেছে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামী এবং বিরোধীদল বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী কি অপূর্ব দৃশ্যপট বাংলাদেশের! অথচ সবার মুখে ‘বলো হরি’, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক! হেফাজতের পোয়াবারো- সরকার হাত ছেড়ে দিলেই বিএনপির দিকে ভিড়বে। সরকার এই ভয়ে হেফাজতের হাত ছাড়ে না। হেফাজতও সেই সুযোগে ক্ষমতাসীন দলের কাছে সুবিধা আদায় করে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকলে আইন আদালতেরও তোয়াক্কা করতে হয় না। জামিন নেওয়ার জন্য আদালতে যেতে হয় না। বেহিসাবি সুযোগ আছে। একটা সময় পর্যন্ত জাতীয় পার্টি ছিলো রাজনীতির তুরুপের তাস।
তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয়ের টানাটানি। এখন জাতীয় পার্টিকে ছাপিয়ে হেফাজতের মূল্য। তোমরা হেফাজতকে হেফাজত করবে। বিনিময়ে হেফাজত তোমাদের হেফাজত করবে। সবার হেফাজতে থেকে আরও বড় হবে হেফাজত। রাজনীতি থেকে এক নারী প্রায় বিদায় নিয়েছেন, আরেক নারীকে বিদায় দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে হেফাজত। পাকিস্তানের দৃশ্যপট ভয়াবহ। তেহেরিক-ই লাব্বাঈক পাকিস্তান (টিলপি’র) নেতাদের আটকের পর সাধারণ সেনাসদস্যদের যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, তাতে বোঝা যায় তাদের মূল কতো গভীরে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ইমরান খান বাপের বেটার মতো ফ্রান্সবিরোধী ফাঁপা বুলি মারছেন।
কিন্তু এভাবে কতোদিন? আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার হতে যাচ্ছে। এর ফলে দেশটিতে তালেবান আরও প্রবল হবে এবং অদূর ভবিষ্যতে আবারও ক্ষমতায় যাওয়া অসম্ভব নয়। এর ঢেউ পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত গড়ানোর প্রবল সম্ভাবনা। বিপদ বড় হয়ে ওঠছে বাংলাদেশ! হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে মধ্যরাতে বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হেফাজত হয়তো আপোস চায় এবং সরকার হয়তো চাপে রেখে তাদের বশে আনতে চায়। তবে এই বশ্যতা মোটেই স্থায়ী হবে না। যারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন তাদের মধ্যে কতোজন ফৌজদারি মামলার আসামি জানি না। তাদের কাউকে ধরার পর ‘তিনি এতোগুলো মামলার আসামি ছিলেন’- এমন বলা শোভা পাবে না। আইনের পথে থাকুন। আমি রাজনৈতিক সমাধানের পথ বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছি না। সেই সমাধান তালেবানবিরোধী জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে সম্ভব। তার জন্য সুস্থ গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন দরকার। আইনের শাসন নিশ্চিত করুন। যাকে ইচ্ছা ধরবো, যাকে ইচ্ছা ধরবো না- একে আইনের শাসন বলে না। ফেসবুক থেকে