মেহেদী হাসান: [২] ১৯৯১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে রাজবংশীদের সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের কিছু বেশি। যদিও সেই শুমারিতে প্রকৃতিপূজারী শৈব রাজবংশীরা হিন্দু পরিচয়ে লিপিবদ্ধ ছিলো। গত ত্রিশ বছরে এ সংখ্যা কমেছে নিশ্চিত। রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী খুঁজলে হাজার তিনেকের বেশি পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। যারা আছেন তারাও এখন রাজবংশী না। হিন্দু এবং বাঙালি পরিচয়ে প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে একটি জাতিসত্ত্বা। যাদের নিজস্ব কোনো ভাষা বা বর্ণমালা না থাকলেও সঙ্গীত আর নৃত্যকলায় ঐতিহ্য আছে। বিশেষ করে ভাওয়াইয়া গানে।
[৩] রাজবংশী নামে যে একটা আদিবাসী সম্প্রদায় বাংলাদেশে আছে, তা খুব বেশি মানুষ জানেই না। একজন মাত্র খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব নিজের নামের সঙ্গে সম্প্রদায়ের নাম যুক্ত করে তবু জানান দিতে চেষ্টা করছিলেন বিশ্ববাসীকে। তিনি ইন্দ্রমোহন রাজবংশী। দেশ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব একুশে পদক দিয়ে সম্মান জানিয়েছে।
[৪] মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণটাও দারুণ এক গল্প। তখন তিনি ঢাকায় এক স্কুলে শিক্ষকতা করেন, ২৫ বছরের যুবক। যুদ্ধে যোগ দিতে ভারতে যাওয়ার সময় নরসিংদীতে ধরা পড়লেন পাকিস্তান আর্মির হাতে! উর্দু চলচ্চিত্র দেখার সুবাদে সেই ভাষাতেও ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর ভালো দখল ছিলো। উর্দুতে কথা বলে পাকিসেনাদের মুগ্ধ করে দিলেন। নিজের ধর্ম, বর্ণ, জাত, নামের দিলেন ভিন্ন পরিচয়। নিজে তো বাঁচলেনই, মুক্তিযুদ্ধগামী গোটা একটা দলকে বাঁচিয়ে দিলেন! আগরতলায় গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলেন। সারাদিনের প্রশিক্ষণের পর সন্ধ্যায় ক্যাম্পে গান গেয়ে সহযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতেন ইন্দ্রমোহন রাজবংশী। সেই গান শুনে একজন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক তাকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পাঠিয়ে দিলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। শুরু হলো নতুন যুদ্ধ।
[৫] মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই একমাত্র রাজবংশী। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বেসামরিক খেতাবে ভূষিত একমাত্র রাজবংশী নিশ্চিতভাবেই ইন্দ্রমোহন। ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর মৃত্যু শুধু একজন ব্যক্তির মৃত্যু না, শুধু একজন শিল্পীর মৃত্যু না, শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা বা কণ্ঠযোদ্ধার মৃত্যু না... একটি জাতিগত সম্প্রদায়ের মৃত্যুঘন্টাও...
নজরুল ইসলামের ফেইসবুক থেকে সংগৃহীত।