আরিফ আজাদ: আমরা যখন নতুন নতুন দ্বীন প্রাকটিস শুরু করি, যখন নফল ইবাদাতে, সুন্নাহ পালনে, দ্বীনের যাবতীয় খুঁটিনাটি কঠোরভাবে মেনে চলতে শুরু করি, আমাদের অন্তরে তখন একধরনের উৎফুল্লতা কাজ করে। সন্দেহ নেই এই উৎফুল্লতা রবের কাছাকাছি যাওয়ার আনন্দ-বিশেষ বৈ কিছু নয়।
তবে, অত্যধিক আমল-ইবাদাত আমাদের মনে একটা অহংকারও তৈরি করে দেয়। এই অহমিকা শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকেই উদ্ভুত। কিন্তু, এটা যে শয়তানের কারসাজি তা বুঝে উঠা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য মুশকিল হয়ে যায়।
ধরা যাক— ফযরের সালাত আমি জামা'আতে আদায় করেছি। ফযরের পর লম্বা সময় কুরআন তিলাওয়াত করেছি এবং সম্পাদন করেছি ফযর পরবর্তী যাবতীয় সুন্নাহ সমর্থিত কাজগুলোও।
কিন্তু সমস্যা হলো— ওইদিন আমার নিজেকে 'বিশেষ' মুসলিম বলে মনে হবে। মনে হবে— 'আহা! আজকের দিনে আমার মতো উত্তম আমলদার আর ক'জন আছে? ক'জন আছে যারা ফযরে জামা'আতে এসেছে, কুরআন তিলাওয়াত করেছে, যাবতীয় সুন্নাহ-নফল আমল করেছে?'
আমি জানি এই সমস্যা আমাদের অধিকাংশেরই। একটু আমল বাড়লেই আমরা নিজেদের অন্য উচ্চতায় ভাবতে শুরু করে দিই। আশপাশের লোকজনকে দেখলে মনে হয়— 'এই লোক হয়তো আজ ফযরটাও পড়ে নাই'। 'এই লোকের আজ কি কুরআন হাতে নেওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার মতো?' 'এই লোক শেষ কবে তাহাজ্জুদ পড়েছে মনে করতে পারবে? অথচ আমি তো প্রায় রোজ...'। 'এই লোক কি সালাতুত দোহা পড়ে?' 'এই লোক কি নিয়মিত সাদাকা করে?'
আমলগুলো নিঃসন্দেহে আমাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে, তবে সেটার প্রকাশ কোনোভাবেই আমাদের ভাবনাতে আনা যাবে না। আমাদের এই আমলগুলো যদি আমাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে, তবে তা একান্তই আল্লাহর চোখে।
যদি আমি মনে করি যে— তাহাজ্জুদ পড়ি বলেই আমি আশপাশের সবার চাইতে সেরা মুসলমান, তাহলে ইখলাস শুদ্ধ করতে হবে সবার আগে। আমার তাহাজ্জুদ তখন যতোখানি না আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, তারচে বেশি আত্মতুষ্টি এনে দেয় আমার নফসকে। আর নফসের এই তুষ্টি আমলকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য একেবারেই যথেষ্ট!
যেহেতু আমরা জানি না আমাদের কোন আমল আল্লাহ কবুল করছেন আর কোন আমল প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, তাই কোন আমলই, হোক সেটা বড় কিংবা ছোট— আমাদের অন্তরে তা যেন আত্মতৃপ্তি না এনে দেয়। মনে রাখতে হবে— ইবলিশ ছিলো সবচে আমলওয়ালা এক নেককার জ্বীন। তার ধ্বংসের কারণ একটাই— আত্মম্ভরিতা।
আপনার নফসের ঘোঁড়া যদি এভাবে ছুটতে থাকে, তাহলে তার লাগাম টেনে ধরবার এখনই সময়।
কিন্তু, ধরবেন কীভাবে?
দু'য়ার মাধ্যমে। নিজের জন্য ব্যাপকহারে দু'য়া করতে হবে।
নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী উম্মু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে জানতে চাওয়া হলো— 'কোন দু'য়াটা নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে বেশি করতেন?'
যেহেতু তিনি নবিজীর স্ত্রী, কোন দু'য়া নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি আওড়াতেন, তা তাঁর চাইতে ভালো আর কে জানবেন?
তিনি উত্তরে বললেন, 'নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দু'য়া সবচেয়ে বেশি করতেন সেটা হলো— يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِى عَلَى دِينِكَ
'ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলুব, সাব্বিত ক্বালবি 'আলা দ্বীনিক'।
কেনো এই দুয়া নবিজী এতো বেশি করতেন? দু'য়াটার অর্থ জানলে সেটার একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। দু'য়াটার সরল অর্থ হলো— 'হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী, আপনি আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের ওপরে দৃঢ় রাখুন'।
অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা। আপনি আজকে পাক্কা মুমিন, আল্লাহ যদি চান যে তিনি আপনার থেকে হিদায়াত ছিনিয়ে নেবেন, তাহলে আগামিকাল সকালে পাক্কা কাফির অবস্থায় আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন। সকালে মুমিন আর সন্ধ্যায় কাফির হয়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের চারপাশেই অহরহ। এজন্যেই দুয়াটাতে আল্লাহর রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহকে 'অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী' বলে সম্বোধন করেছেন, কারণ এই ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতেই। দুয়াটায় আরো আছে— 'আপনি আমার অন্তরকে দ্বীনের ওপর দৃঢ় করুন।'
মানে হলো— হিদায়াতের রাস্তা থেকে আমাকে বিচ্যুত করবেন না। দ্বীন থেকে আমাকে বিপথে নিয়ে যাবেন না। দ্বীনের ব্যাপারে আমার মনে সন্দেহ তৈরি হতে দেবেন না।
নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন দুনিয়ার বুকে পদচিহ্ন রাখা সবচে সেরা মানুষ! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা নবিজীকে বাছাই করেছেন সারা জাহানের জন্য। তাঁকে সম্মানিত করেছেন নবুয়্যাত দিয়ে। আল্লাহর মহা-সম্মানিত নবি হওয়ার পরেও তিনি নাকি দুয়া করছেন এভাবে যে, তাঁর অন্তর যেন দ্বীনের ওপর দৃঢ় থাকে। তাঁর অন্তর যেন দ্বীন থেকে বিচ্যুত না হয়! তাঁর কি ভয় ছিলো পথ হারাবার? তাঁর কি আশঙ্কা ছিলো দ্বীন থেকে গাফেল হওয়ার? একদম না। তারপরও তিনি দুয়াটা করেছেন।
আর, আমরা যারা একটু আমল করে নিজেকে অনেক বড় তালেবর ভাবতে শুরু করি, আমাদের কে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, আমরা ঈমান সহকারে মৃত্যুবরণ করতে পারবো? আল্লাহর আযাব যে আমাদের পাকড়াও করবে না— তার কী গ্যারান্টি?
দ্বীন থেকে বিচ্যুতি, দ্বীন থেকে বিপথগামী হওয়া আর দ্বীনের ব্যাপারে অন্তরে সন্দেহের দানা তৈরিতে সবচে জোরালো ভূমিকা রাখে নিজের ব্যাপারে অধিক আত্মবিশ্বাস। এমন ভাবা যে— আমার চাইতে নেককার, আমলদার, পরহেযগার বুঝি খুব কমই আছে চারপাশে!
আপনার নফসের তাগড়া ঘোঁড়াটার লাগাম টেনে ধরতে, নিজেকে আত্মম্ভরিতার দুনিয়া থেকে টেনে নামাতে নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু'য়াটাকে নিত্যসঙ্গী বানিয়ে ফেলুন। বেশি বেশি আওড়ান— 'ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলুব, সাব্বিত ক্বালবি 'আলা দ্বীনিক'।