রাশিদ রিয়াজ : কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. ফরিদা খান পাকিস্তানের সাউথ এশিয়ায় তার ‘টেকিং স্টক’ প্রবন্ধে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিস্ময় প্রকাশ করে এমন প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। তার বিস্ময় এ কারণে যে এবছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশ একটি জাতিতে পরিণত হয়ে ওঠার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছে যার আগেই দেশটি তার অর্থনীতিতে রকেটের মত গতি সৃষ্টি করতে সমর্থ হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবৃদ্ধি নেতা হিসেবে প্রশংশিত হচ্ছে। গত বছর বাংলাদেশের আনুমানিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮% এর উপর ভিত্তি করে এশিয়ার দ্রুত বর্ধমান দেশগুলির একটিতে পরিণত হয়েছে, এবং আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে যে তার মাথাপিছু জিডিপি (বা আয়ের গড় স্তরের পরিমাণ) অর্থবছরের ২০২০ সালে ভারতের তুলনায় বেশি হতে পারে।
কিন্তু বাংলাদেশে এটা কিভাবে ঘটল ?
বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক অর্জনের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়েছিল সত্তর দশকের শেষের দিকে উদারিকরণের দিকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণে যাত্রার মধ্যে দিয়ে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে দাতাদের উদ্যোগ আগের সেই উদ্যোগে আরো শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে দেয়। দেশটির সামাজিক উন্নয়ন দেখার মত। এধরনের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশটির লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র সীমার বাইরে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। ১৯৮৫ সালে দারিদ্রের হার ২০১৮ সালে কমিয়ে ২১.৮ শতাংশে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে ৭৯ শতাংশ। এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার ৮৩ শতাংশ কমেছে, লিঙ্গ সমতার দিক থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি চিত্তাকর্ষক হারে ৯২% এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ৭২% হারে পৌঁছে যায়। এই সামাজিক বিকাশ অর্থনৈতিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি গঠন করে। সামাজিক বিকাশের আরেকটি দিক, প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত হিসেবে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশকে গণতন্ত্রে রূপান্তরিত করা। গবেষণায় দেখা গেছে যে সামরিক শাসনের অবসানের পরেই আইন-শৃঙ্খলা, আমলাতন্ত্রের মান, রাজনৈতিক অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতার মতো ব্যবস্থাগুলি উন্নত হয়েছিল এবং গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার আবির্ভাব ঘটে। এরপর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে অবকাঠামোতে বিনিয়োগের গতি বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, সেতু, হাসপাতাল, স্কুল এবং প্রশাসনিক অফিস সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত হয়ে পড়ে। ১৯৯১ সালে মেঘনা নদীর উপর একটি সেতু এবং ১৯৯৯ সালে যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের ফলে এই বিস্তৃত নদীগুলির দ্বারা বিভক্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে সংযুক্ত করার একটি মূল অবকাঠামো তৈরি হয় যা পণ্যের অবাধ সরবরাহকে নিশ্চিত করে। পদ্মা সেতুর বর্তমান নির্মাণ, যা দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে সড়ক ও পরিবহন সংযোগকে পুরোপুরি সম্পন্ন করবে এবং তা অবধারিতভাবে বাজারের উন্নয়ন এবং শ্রম চলাফেরার সুবিধা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে এবং এসবই হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, নতুন করে কৃষি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা হয়। এতে শীত মৌসুমে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এবং ‘শেয়ার ক্রপিং’ এর মাধ্যমে কৃষি জমিতে অংশীদারিত্বের চাষাবাদ শুরু হয়। প্রতিদিনের মজুরি চুক্তির পরিবর্তে একাধিক সময়ে কাজের সুযোগ পায় কৃষি শ্রম। পাশাপাশি বাজারে বাড়তি কৃষি পণ্যের যোগান বৃদ্ধি পায়। কৃষকদের পরিবহন ও বিতরণ ব্যয় হ্রাস করে দেওয়ায় তাদের আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এর আরেকটি ফল হল গ্রামীণ অঞ্চলে অকৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি। একই সঙ্গে সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রেও প্রশংসনীয় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। বেসরকারি সংস্থাগুলো যে ঋণ সরবরাহ করেছিল যা দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং গ্রামীণ অঞ্চলগুলির অর্থায়নে ব্যাপক সহায়তা সৃষ্টি করে, যেখানে সরকারি মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পিছিয়ে পড়েছিল বা ব্যর্থ হয়েছে এমন স্থানে শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এসব এনজিও প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ করেছিল এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং মৌলিক আইনী অধিকারের পক্ষে সমর্থন যুগিয়েছে। এসব উদ্যোগ বাংলাদেশকে বদলে দেওয়ার এমন ভিত্তি রচনা করে। এর সঙ্গে যোগ হয় মোবাইল ফোন প্রাপ্তি। গ্রামীণ ফোন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ১৯৯৭ সালে কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফোনের বিস্তৃতি নেটওয়ার্ক স্থাপিত হয়। সামাজিক অবকাঠামোতে এটি আরো অবকাঠামোগত সুযোগ বৃদ্ধি করে। এসব ফোন পরিচালনকারীর ৭৫ শতাংশ ছিলেন নারী যা বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রচার, কৃষি-ব্যবসা উন্নয়ন ও নারীদের সামাজিক ক্ষমাতায়নে ভূমিকা রাখে। ২০১১ সালে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয় এবং এর ফলে শহর থেকে পুঁজির প্রবাহ সহজেই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পৌঁছাতে শুরু করে। গ্রামীণ অর্থনীতির চেহারা পাল্টে যেতে থাকে।
অবশেষে অনেক শ্রমিক যাদের সিংহভাগ নারী তারা আশির দশক থেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে গার্মেন্টস কারখানায় কর্মসংস্থান বেছে নেয়। এভাবে ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক গার্মেন্টস কারখানায় উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হয় যা দেশটির ৮০ শতাংশ রফতানি আয়ে অবদান রাখে। কারখানাগুলিতে কাজ করা তরুণীরা নারীদের স্বাধীনতা ও পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা তাদের গ্রামীণ পাড়া পড়শীদের মধ্যে স্বায়ত্তশাসন এবং মজুরির কাজের ধারণাগুলি সঞ্চারিত করেছে। বাংলাদেশকে রিজার্ভের ক্ষেত্রে স্থিতিশীল রেখে এ পোশাক খাতটি প্রবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। অতিরিক্ত এবং সমানভাবে মূল বৈদেশিক মুদ্রার উপার্জনকারীরা বিদেশি কর্মী, প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে, তবে এশিয়ার অনেক দেশ, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তারা কাজ করে যাচ্ছে। বেশিরভাগ রেমিটেন্স মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে যা পুরো দেশজুড়ে গ্রামাঞ্চলে মূলধনের যোগান অব্যাহতভাবে ধরে রাখার জন্যে এক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, পাশাপাশি বাংলাদেশকে দাতাদের তহবিলের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাসে সহায়তা করেছে।
মোটকথা জনসংখ্যার অবিচ্ছিন্নতা, একটি বিশাল এবং অনিয়ন্ত্রিত অনানুষ্ঠানিক খাত, রাজধানী ঢাকার মত মেগাসিটিতে অস্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি, আর্সেনিক এবং অন্যান্য সমস্যার কারণ ভূগর্ভস্থ পানির হ্রাস, অনেক নদী শুকিয়ে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশ ধীরে ধীরে তার সামাজিক বিকাশের উপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে তুলেছে। এমনকি এশিয়ার যে কোনো দেশের চেয়ে সর্বনিম্ন বনভূমির হার ও বনাঞ্চল কমে যাওয়ার পরেও। সমৃদ্ধির এই পথটি অব্যাহত থাকবে কিনা তা পরীক্ষার ওপর নির্ভরশীল বা সময় তা বলে দেবে। জিডিপির সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশের রাজস্ব ঘাটতি, মধ্যম মূল্যস্ফীতি এবং বিনিময় হারের স্থিতিশীলতার সাথে অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা নির্ভর করে। করের আওতায় নিম্ন হার যা ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। তবে মহামারী চলাকালীন এই সময়ে গত বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহ ২০ শতাংশ বেশি এসেছে। তবে রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধির একটি কারণ হতে পারে যে এখনো তা আসছে কারণ করোন ভাইরাসজনিত কারণে প্রবাসীরা বিদেশি চাকরি থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। কোভিড মহামারীর কারণে অর্র্থনৈতিক প্রয়োজনের কারণে আরও বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন তারা, এ বিষয়টিও সত্য। এর পাশাপাশি গার্মেন্টস খাতে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে এবং ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে যাওয়ার পর এ খাতে ফের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে চীন এবং ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ ওই দুটি দেশ তাদের মুদ্রাকে অবমূল্যায়ন করেছে। অন্যদিকে মহামারীর সময়ে বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, অবশ্য এতে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বেশিরভাগ কারখানার ক্ষেত্রে উৎপাদন গড়ে ৮০ শতাংশেরও কম হ্রাস পেয়েছে।
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে স্বৈরাচারবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সংসদে শাসকদলের নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এরফলে কার্যকরভাবে প্রধান বিরোধীদল ধ্বংস হয়ে পড়ছে। এধরনের রাজনৈতিক বিঘ্নের সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্বল ব্যাংকিং খাত যা খেলাপি ঋণকে আরো বৃদ্ধি করতে সহায়তা করেছে এবং এতে সরকারের কিছুটা উৎসাহ রয়েছে। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক জোরদার উদ্যোগ প্রয়োজন তার বিপরীত। যদিও সার্বিক অর্থনীতি তাৎক্ষণিকভাবে মহামারী পরবর্তী পরিস্থিতিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে পারবে কি না তা দেখার এখনো বাকি আছে।