অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: আজকে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করছি তার উৎসই হচ্ছে ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন। বাঙালি ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিা করে গেছেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতা ধর্মঘাট করে। ভাষা আন্দোলনের দাবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন পাকিস্তানে এই দিনটিতে কারাগারে বন্দী হন যার কারণে এই দিনটি ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। পাকস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মাত্র ৬-৭ মাস পরেই বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দী হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ্ ঘোষণা দেন একমাত্র উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। তার প্রতিবাদে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যৌক্তিক দাবি তুলে বললেন, পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা হচ্ছে বাংলা। সুতরাং পাকিস্তানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। পাশাপাশি তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, পূর্ব বাংলার প্রধান ভাষা হবে ‘বাংলা’, পশ্চিম পাকিস্তানে তোমাদের মতো করে ভাষা ঠিক করতে পারবা। এ ধরনের যৌক্তিক দাবি করার পরেও বঙ্গবন্ধুকে ১১ মার্চে কারাগারে প্রেরণ করা হলো। এর পরেই ভাষা আন্দোলনের দাবিতে বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলন শুরু হতে থাকলো। যার চ‚ড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।
এই দিনে পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করলো। কিন্তু শুরু থেকেই বাঙালির ভাষা আন্দোলনকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি বরং সেই সময় চার কোটি বাঙালি ঐক্যবদ্ধভাবে ভাষা আন্দোলন চালিয়ে যায় এবং বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশের এতো সম্মান অর্জনের জন্য বহু মানুষের রক্ত, শ্রম ও সংগ্রাম করতে হয়েছে।
এতো ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছি কিনা সেই বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। নিজেদর আত্মসমালোচনা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু এতো কষ্ট করে আমাদের যে স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়ে গেলেন, সেই বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে আমরা কতোটুকু মর্যাদা দিতে পেরেছি? এখনো আমরা উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। উচ্চশিক্ষায় আমরা ভালোভাবে বাংলাভাষা ব্যবহার করতে পারছি না। সকল সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলা ভাষাকে সকল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজেই অনেক পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, পরিভাষার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। যেখানে পরিভাষার প্রয়োজন আছে, সেখানে পরিভাষার জন্য বোর্ড গঠনের কথা বলেন তিনি। স্বাধীনতার পরপরই তিনি সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিতে বলেন। আমরা ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কেবল বাংলা ভাষা নিয়ে কথা বলি। বাংলাদেশের দোকান এবং বিলবোর্ডগুলো ইংরেজিতে লেখা কিন্তু পাকিস্তান আমলে এসব চিন্তাই করা যেতো না। কারণ সে সময় মানুষের ভাষা সচেতনতা বেশি ছিলো। প্রত্যেকেই তাদের বাসার সাইনবোর্ড বাংলায় করার জন্য আগ্রহী ছিল।
এখন মনে হয় সহজেই বাংলা ভাষা পাওয়ার কারণে নিজেরাই এর মর্যাদা নষ্ট করছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলার গৌরব-ঐতিহ্য ও অহংকার সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে এগুলো জানলে তারা বাংলা ভাষাকে সম্মান করতে শিখবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এক ধারার অর্থ্যাৎ বাংলা ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিলো। সেই স্বপ্ন আমরা এখনো বাস্তবায়ন করতে পারিনি, এটা আমদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের এবং লজ্জার।
পরিচিতি : শিক্ষাবিদ। অনুলেখক : আব্দুল্লাহ মামুন