ডেস্ক রিপোর্ট: ১. গণমাধ্যমের শিক্ষার্থীমাত্রেই জানেন তবু আবার বলি, সব সংবাদই তথ্য, কিন্তু সব তথ্যই সংবাদ নয়। সংবাদমাধ্যমকে নানা ধরনের তথ্য নিয়ে কাজ করতে হয়। এর মধ্যে সঠিক ইনফরমেশনের [তথ্যের] পাশেই থাকে মিসইনফরমেশন, ডিজইনফরমেশন, ম্যালইনফরমেশন [অপতথ্য বা তথ্যের পরিকল্পিত, উদ্দেশ্যমূলক অপ’ব্যবহার]।
মিসইনফরমেশন: মানে ভুল তথ্য। অজ্ঞতা বা অ-সতর্কতার কারণে সাংবাদিকরা মাঝেমধ্যে এমন ভুল তথ্য যে ব্যবহার করেন না এমন নয়। সরল বিশ্বাসেই করা হয়। ভুল ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভুল স্বীকার করা সাংবাদিকতার নান্দনিকতারই অংশ।
ডিজইনফরমেশন: কোনো ব্যক্তি, সামাজিক গ্রুপ, সংগঠন বা দেশকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য ভুল তথ্যের ইচ্ছাকৃত ব্যবহার।
ম্যালইনফরমেশন: তথ্যটি সঠিক। সঠিক তথ্যকে কোনো ব্যক্তি, সামাজিক গ্রুপ, সংগঠন বা দেশের বিরু’দ্ধে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার। হালে ভালে সাংবাদিকতার প্রচারণায় ইউনেস্কো তথ্যের এ বিষয়গুলো বেশি বেশি সামনে আনছে, যাতে সাংবাদিকতা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়।
২. তথ্য নিয়ে এই টেক্সটবুক তত্ত্ব সামনে আনতে হলো আল-জাজিরায় বাংলাদেশসংক্রান্ত ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’টি আলোচনার জন্য। কোনো গণমাধ্যমে কোনো কিছু প্রকাশিত বা প্রচারিত হলে তার প্রতিক্রিয়া হতে পারে নানাভাবেই। হতে পারে বিষয়টি নিয়ে চুপ থাকা, অগ্রাহ্য করা। হতে পারে, বিষয়টি পরিকল্পিত, উদ্দেশ্যমূলক, ভিত্তিহীন, মনগড়া বলে প্রত্যাখ্যান করা। অথবা বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়া, মামলা করা।
আবার এমনও হতে পারে প্রচারিত খবর বা অনুষ্ঠানের তথ্য, উপস্থাপনা ধরে ধরে যুক্তি দিয়ে সব খণ্ডন করা। আল-জাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে দুটি ধারা লক্ষ্য করছি। একদল বলছেন ‘সব ঝুটা হ্যায়’। আরেক দল খুবই উল্লসিত, এ সরকার পড়ল বলে!
একটি ধারার মত- প্রতিবেদনটি সবটাই ভুয়া, তা প্রত্যাখ্যান করা, আল-জাজিরা একটা খারাপ প্রতিষ্ঠান, তারা উ’গ্রবাদীদের সমর্থন দেয়, তারা ভুল খবর দেয়, কাজেই তাকে বিশ্বাস করা যায় না, সবটাই অপপ্রচার। দ্বিতীয় ধারা হচ্ছে- আল-জাজিরা সঠিক কাজটিই করেছে, এবার সরকার বুঝুক ঠ্যালা!
সবাই তাদের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী বিষয়টি বিবেচনা করছেন। করুন, তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে বলি, কোনো গণমাধ্যমের সমালোচনা করার সময় একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিটি গণমাধ্যমের একটি সম্পাদকীয় নীতি থাকে। সবাই সেই নীতির সঙ্গে একমত হবেন এমনটি না-ও হতে পারে। যেমন ধরা যাক, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সম্পাদকীয় নীতি নিয়ে যেমন অনেক গণমাধ্যম পরিচালিত হয় তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেছে এমন রাজনীতির মুখপত্রও প্রকাশিত হয়।
কারও পছন্দ হোক বা না হোক আল-জাজিরা তাদের সম্পাদকীয় নীতি দিয়েই পরিচালিত হয়, সেটি তারা গোপনও করে না। আল-জাজিরার মালিক সে দেশের রাজ পরিবার। আল-জাজিরা পৃথিবীজুড়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে কিন্তু কাতারে রাজ পরিবারের নানা নাটক নিয়ে কিছু বলে না, সে দেশে বিশ্বকাপ ফুটবলের স্টেডিয়াম বানাতে গিয়ে বিদেশি শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোর ক্ষেত্রে যে মানবাধিকার ল’ঙ্ঘন হয় সে বিষয়ে কোনো কথা বলে না।
এই মালিকানার সম্পাদকীয় নীতি নিয়ে আল-জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক ইংরেজি ছাড়াও আরও প্রায় ৫টি চ্যানেল পরিচালনা করে। এর একটি হচ্ছে- আল-জাজিরা মোবাশ্বের। আরবি ভাষায় পরিচালিত এ চ্যানেলটি আরব দেশগুলোয় আলোচিত-সমালোচিত। এর সঙ্গে আল-জাজিরা ইংরেজির খুব মিল নেই। যেমন- যে সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল আমরা দেখি তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রচারিত সিএনএন এক নয়।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। মিশরে ইসলামিক ব্রাদারহুড শাসনামলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয় ‘আল-জাজিরা মোবাশ্বের’। কিন্তু ব্রাদারহুড সরকারের প’তনের পর সেখানে আল-জাজিরার অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং আল-জাজিরার কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংগঠনের প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে এ নিবন্ধকারও মিশর গিয়েছিলেন সেই সাংবাদিকদের মুক্তির দাবি নিয়ে।
সে সময় নতুন সরকারের যতজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি, সে দেশের তথ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা সাংবাদিক নেতাদেরসহ, তারা সবাই বলেছেন- মিশরে আল-জাজিরা মোবাশ্বের আসলে ব্রাদারহুডের শাখা হিসেবে কাজ করেছে।
তারা আমাদের ছবি দেখিয়েছেন যে, আটক সাংবাদিকের অন্তত দুজন সাংবাদিকতার নামে মাঠে থাকলেও ব্রাদারহুডের পক্ষে রাজপথে মিছিলে অংশ নিয়েছেন। তাদের আটক করা হয়েছে ব্রাদারহুডের কর্মী হিসেবে, সাংবাদিক হিসেবে নয়। কাজেই আল-জাজিরার উ’গ্র ডান সমর্থনও গোপনীয় কিছু নয়।
বাংলাদেশ নিয়ে রিপোর্টটি সম্প্রচার করেছে আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট। আল-জাজিরার যাত্রা ১৯৯৬ সালে, তবে ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিটের যাত্রা ২০১২ সালে। নিজস্ব কোড অব এথিকস দ্বারা এটি পরিচালিত হলেও এর সম্পাদকীয় নীতি আল-জাজিরার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গেই একাত্ম।
এ ইউনিট এর মধ্যেই ৪০টির মতো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। মনোনীত হয়েছে শতাধিক পুরস্কারের জন্য। তাদের অনুসন্ধানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পাকিস্থান’স বিন লাদেন ডসিয়ার (বিন লাদেনকে নিয়ে পাকিস্থান সরকারের অভ্যন্তরে কী ঘটেছে এসব নিয়ে প্রামাণ্য), কেনিয়াস ডেথ স্কোয়াড, অ্যানাটমি অব ব্রাইব ইত্যাদি।
এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য, এই মানের আল-জাজিরার কোনো প্রতিবেদন সম্পর্কে সমালোচনার আগে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই কথা বলতে হবে। আল-জাজিরার সাংবাদিকতার মান সব সময়ই যে উচ্চ হয়েছে এমন নয়। যেমন বাংলাদেশে মতিঝিলে হেফাজতের আন্দোলনে নিহ’তের সংখ্যা নিয়ে তাদের রিপোর্ট ছিল পুরোটাই অসত্য।
সে রিপোর্ট নিয়ে আল-জাজিরার সিনিয়র সাংবাদিক কর্মকর্তদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ দিয়ে কথা বলার সময় তারা বলেছিলেন, ওই তথ্যের উৎস ছিল বাংলাদেশেরই একটি সংগঠন। নিজস্ব অনুসন্ধান না করে শুধু কারও দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সংবাদ প্রচার যে ঠিক হয়নি তা তারা মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। ধারণা করি তাদের এবারকার প্রতিবেদনের সূত্রও দেশে বা প্রবাসের বাংলাদেশ সম্পর্কিত চক্রগুলোই।
কাজেই তুড়ি মে’রে উড়িয়ে দেওয়া নয়। যুক্তি ও তথ্য দিয়েই আল-জাজিরার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ইনফরমেশন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আল-জাজিরা কতটা মিসইনফরমেশন, ডিজইনফরমেশন, ম্যালইনফরমেশনের মিশেল ঘটিয়েছে সত্যের খাতিরে তা তুলে ধরাই জরুরি।
৩. স্বীকার করতে হবে, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির প্রাথমিক শর্তগুলো আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দল যথেষ্ট ভালোভাবেই পূরণ করার চেষ্টা করছে। তারা দীর্ঘ সময় ধরে তাদের অনুসন্ধান চালিয়েছে। এক দেশ থেকে এমনকি মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যেখানে যেতে হয় গিয়েছে। ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে তাদের বিষয়কে। প্রচুর দলিল জোগাড় করেছে। নিজস্ব লোক নিয়োগ করেছে। নিজস্ব সোর্স তৈরি করেছে।
যথা সম্ভব কথোপকথন রেকর্ড করেছে বা সংগ্রহ করেছে। ছবি তুলেছে এবং ছবি ও ভিডিও ক্লিপ সংগ্রহ করেছে। প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। এসবই একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের অপরিহার্য শর্ত। এতসব করার পরের কাজটি বেশ জটিল, তা হচ্ছে- পাওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই, সূত্র বা উৎস ব্যবহারে কঠোর সতর্কতা, যাতে কোনো সূত্র অনুসন্ধানী দলকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার না করতে পারে। অনুসন্ধানী দলকে পদে পদে সতর্ক থাকতে হয়, কারও ট্র্যাপে যেন পা না যায়।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার টেক্সটবুক সংজ্ঞাটিই হচ্ছে, যে সত্যগুলো কেউ জানে না সেই একবারে আনকোরা নতুন সত্যগুলো তুলে ধরা। একেবারে নতুন বিষয় মানুষকে জানানো। দ্বিতীয় শর্ত, অনুসন্ধানী প্রতিবেদেনে কোনো আধাআধি তথ্যের স্থান নেই, জানাতে হবে পূর্ণ তথ্য। সব প্রশ্নের জবাব থাকতে হবে। এ দৃশ্যপটটি মাথায় রেখেই আল-জাজিরার প্রতিবেদনটির ব্যবচ্ছেদ জরুরি।
প্রথমেই শিরোনাম: ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’। আকর্ষণীয়, ক্যাচি সন্দেহ নেই। একেবারেই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে টার্গেট করা। প্রধানমন্ত্রী শুনেই দর্শক রিমোট হাতে নিয়ে বসে থাকবে কারা তার ‘ম্যান’ বিষয়টি জানার জন্য। কিন্তু দেখার বিষয়, ১ ঘণ্টার সামান্য বেশি সময়ের প্রতিবেদেনে কি এ কথা প্রমাণ করা গেছে যে ‘ম্যান’দের কথা বলা হয়েছে তারা প্রধানমন্ত্রীর লোক?
উত্তর হচ্ছে ‘না’। শিরোনামটি ঢালাও, দর্শক ধরার টেকনিক মাত্র। মনে রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রী একটি দলের সভাপতিও বটে। সে হিসেবে দলের সবাই ‘তাঁর ম্যান’। যখন সুনির্দিষ্ট করে কিছু লোকের নাম ধরে বলব এরা ‘প্রধানমন্ত্রীর লোক’, তখন এ সত্যটি প্রমাণ করতে হবে, এ লোকগুলোকে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন, সব জানা সত্ত্বেও তিনি তাদের সব অপকাজকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, অন্ধভাবে তাদের সমর্থন দিচ্ছেন।
সাদামাটা চোখেই দেখা যাবে পুরো প্রতিবেদনে এ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। ভিন্ন একজনের একটি মাত্র টেলিফোন কথোপকথনকে এর ভিত্তি ধরা যায় কিন্তু এমন দাবি তো অনেকেই করতে পারে। সেটিকে চূড়ান্ত সত্য ধরে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় না, প্রামাণিক সত্য হিসেবে নেওয়া যায় না। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কোনো নির্দেশ বা এ-সংক্রান্ত দলিলই কেবল এ সত্যকে প্রকাশ করতে পারে। কাজেই প্রতিবেদনটির শিরোনামটিই ডিজইনফরমেশন, বিশেষ উদ্দেশ্যে ভুল তথ্যের প্রচার।
প্রতিবেদনের বাকি অংশকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে- দুর্নীতি, অর্থ পাচা’র, জালিয়াতি, আইনভঙ্গ, ব্যক্তি সম্পর্ক। দেখার বিষয় এ জায়গাগুলোয় প্রামাণিক সত্য উপস্থাপন করা হয়েছে কি না। পুরো প্রতিবেদনে আল-জাজিরা প্রায় ৩৫টি দলিল ব্যবহার করেছে এসব প্রমাণের জন্য।
দুর্নীতি ও অর্থ পাচা’র: প্রতিবেদনের নানা পর্যায়ে নানা দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে কিছু দালিলিক প্রমাণও দেখানো হয়েছে। কতগুলো দলিলভিত্তিক ধারণা থেকে একটি উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে দুর্নীতি হয়েছে। এটা এক ধরনের ‘ধারণাগত দুর্নীতি’, দুর্নীতির প্রমাণিত সত্য নয়। সেই পদ্মা সেতুর ঘুষ তালিকার দুর্নীতির মতোই।
জালিয়াতি ও আইনভঙ্গ: প্রতিবেদনে এখানে কিছু দালিলিকভাবে প্রমাণিত সত্যি আছে। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে জাল পাসপোর্ট তৈরি অবশ্যই বড় ধরনের জালিয়াতি।
তবে বাংলাদেশে এ ধরনের অপকর্মের জন্য ‘প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ হওয়ার দরকার পড়ে না। খোদ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সই জালিয়াতির তথ্য আমাদের অজানা নয়। এ দেশে জাল পাসপোর্ট বা এনআইডি তৈরির ঘটনাও নতুন নয়। তবে প্রতিবেদনে জাল কাগজপত্র তৈরি করে জাল পাসপোর্ট তৈরির ঘটনা অবশ্যই তদন্তের দাবি রাখে, এ বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও হতে পারে।
তেমনি এ বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ যে, সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বাংলাদেশে এলোই বা কী করে, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় রাষ্ট্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশই বা নিল কী করে? নিশ্চয়ই এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা জরুরি, অনুসন্ধান হতে পারে এ বিষয়েও।
ব্যক্তি সম্পর্ক: একজন ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করলেও সরকারি দায়িত্বের বাইরে তিনি পারিবারিক মানুষ। দেশে বা দেশের বাইরে পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ তার ব্যক্তিগত বিষয়। এ ব্যক্তিগত যোগাযোগ যতক্ষণ পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালন বা রাষ্ট্রের কোনো কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত না করে ততক্ষণ পর্যন্ত তা ব্যক্তিগতই।
প্রতিবেদনে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি যে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পর্কের সূত্র ধরে কেউ অ’ন্যায়ভাবে লাভবান হয়েছেন বা রাষ্ট্রের ক্ষ’তি করেছেন। তবে এ বিষয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন তোলা যায়।
৪. প্রসঙ্গ ডেভিড বার্গম্যান: তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে। বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর কড়া সমালোচনামূলক অবস্থান খুব একপেশে, কখনো কখনো কট্টর। কারণ যাই হোক, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান সরকার সম্পর্কে তাঁর বৈরী অবস্থান দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান। বাংলাদেশের নানা বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট পক্ষপাতমূলক অবস্থান রয়েছে।
অন্য উদাহরণগুলো বাদ দিয়ে সবশেষ দৃষ্টান্ত তুলে ধরি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত ২৭ জানুয়ারি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের সাউথ এশিয়া সেন্টার ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড ভিশন্স অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক আলোচনার আয়োজন করে। এতে মূল বক্তা ছিলেন নোবেলজয়ী ড. অমর্ত্য সেন, ঢাকা থেকে এ আলোচনায় যুক্ত হন অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
সাউথ এশিয়া সেন্টার এ আলোচনার ঘোষণাটি দেওয়ার পরপরই ১৯ জানুয়ারি নেত্র নিউজে ডেভিড বার্গম্যান যে কলামটি লেখেন সেখানে তিনি বলতে চান- লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের এ রকম একটি উদ্যোগ নেওয়া উচিত হয়নি। তিনি শেখ মুজিবের শাসনামল এবং শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনায় নানা বিষয় তুলে ধরে এ অনুষ্ঠান আয়োজনের বিরু’দ্ধে অবস্থান নেন।
বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক ডেভিড বার্গম্যান এতটাই মুজিব ও তাঁর পরিবারবিদ্বে’ষী যে, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিষয়ে একটি একাডেমিক আলোচনা অনুষ্ঠান নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার হলেও ডেভিড বার্গম্যান অন্যের মত শুনতে চান না, অন্যকে নিয়ে আলোচনাও করতে দিতে চান না।
সেন্টারের পরিচালক অবশ্য এ বিষয়ে তাঁকে যথাযথ জবাব দিয়েছেন এবং ২৭ জানুয়ারি আলোচনা অনুষ্ঠানটি সফলভাবেই হয়েছে। আল-জাজিরার এ প্রতিবেদনের বড় দুর্বলতা হচ্ছে এহেন পক্ষপাতদুষ্ট ডেভিড বার্গম্যানকে অনুষ্ঠানে ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে হাজির করা। প্রতিবেদনে আরও দু-তিনটি চরিত্র সম্পর্কে একই কথা বলা যায়।
একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের টেক্সটবুক বিধান হচ্ছে- প্রতিবেদকের নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান নিশ্চিত করা, উপস্থাপনায় নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রাখা। কারণ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো প্রামাণিক তথ্য ও দলিল। তথ্য বা দলিল দিয়ে প্রমাণ করা যায় না এমন তথ্য কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে বলিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়।
আবার সেই ব্যক্তিটি যদি প্রতিবেদনে বর্ণিত ব্যক্তি, দেশ বা গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বে’ষমূলক মনোভাব পোষণ করেন তা হবে সাংবাদিকতার নৈতিকতার সঙ্গে সরাসরি সাংঘ’র্ষিক। এ ক্ষেত্রে তাই করা হয়েছে।
পৃথিবীজুড়ে বাংলাদেশ বিষয়ে এত বিশেষজ্ঞ থাকতে বিশেষ করে কেন ডেভিড বার্গম্যান বা তাসনীম খলিলকেই কেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বাছাই করা হলো, যখন তাদের বিদ্বে’ষমূলক পক্ষপাতের অবস্থান খুবই স্পষ্ট। তারা বিশ্বমানের কোনো প্রতিষ্ঠানেরও প্রতিনিধিত্ব করেন না। এখানেই হয়েছে ডিজইনফরমেশন আর ম্যালইনফরমেশনের মিশেল।
৫. এ প্রতিবেদনে আল-জাজিরা তাদের নিজেদের কোড অব এথিক্স নিজেরাই মানেনি। কোড অব এথিক্সের ২, ৫ ও ৭ নম্বরে তাদের নৈতিক অবস্থান যতটা দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে, এ প্রতিবেদনের পরতে পরতে ততটাই তার ল’ঙ্ঘন দেখা যাবে।
প্রতিবেদনের বড় দুর্বলতা হচ্ছে যাদের সম্পর্কে এত অভিযোগ তাদের কারও সঙ্গে কোনো কথাই বলা হয়নি। প্রতিবেদনে খুব মিন মিন করে বলা হয়েছে, তারা সবার বক্তব্য জানতে চেয়েছিল কিন্তু কেউ কোনো সাড়া দেননি। এত সেনসিটিভ একটি বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন, যেখানে একটি দেশ, সে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনা ও পুলিশ প্রধানের মতো ব্যক্তিদের নিয়ে কথা বলা হচ্ছে, সেখানে তাদের কারও কোনো বক্তব্য না নেওয়ার ক্ষেত্রে অজুহাত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
অনুসন্ধানী দল সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইউরোপ চষে বেড়াচ্ছে অথচ মূল ঘটনা যে দেশে সে দেশটিতে একবারও এসেছিল কি না, যাদের বিষয়ে কথা বলছে তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে কি না, কীভাবে চেষ্টা করেছে এ প্রশ্নগুলোর জবাব না থাকাটা উঁচুমানের সাংবাদিকতা নয়।
এটা এক ধরনের উন্নাসিকতা, বাংলাদেশকে খাটো করে দেখার চেষ্টা। মনে করা হয়েছে ডেভিড বার্গম্যান এবং তার সহযোগীরা বলে যাবেন আর সবাই তা গোগ্রাসে গিলবে! ভাবখানা এ রকম যে বাংলাদেশকে নিয়ে যা খুশি তাই বলা যায়।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনটির নির্মোহ বিশ্লেষণ শেষে এ কথা বলাই যায়, এটি হচ্ছে মিসইনফরমেশন, ডিজইনফরমেশন, ম্যালইনফরমেশনের একটি ককটেল। জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তরের ৪ ফেব্রুয়ারির নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিখ যথার্থই বলেছেন, দুর্নীতির অভিযোগগুলো গুরুতর বিষয়। এ অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদন্ত করা উচিত। মানে জাতিসংঘও আল-জাজিরার প্রতিবেদনকে প্রমাণিত সত্য হিসেবে গ্রহণ করেনি, সাদামাটা অভিযোগ হিসেবেই দেখেছে।
কেন এ প্রতিবেদন, কারা এর নেপথ্যে এও বের করা খুব কঠিন নয়। প্রতিবেদনটি প্রচারের পর বিভিন্ন মাধ্যমে যাদের উল্লাসের নৃত্য দেখা যাচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য ও পরিচয় কঠিন গবেষণার বিষয় নয়। এ প্রতিবেদনটি তৈরি ও সম্প্রচার করতে গিয়ে আল-জাজিরাই কোনো কারণে কারও দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে কি না তা নিয়েও অনুসন্ধান চলতে পারে।
৬. সবার মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলি, অন্ধবিশ্বাসে সব গ্রহণ আর অন্ধবিশ্বাসে সব বর্জন- দুটোই মৌলবাদ, দুটোই পরিত্যাজ্য।
চাণক্য মহাশয় রাজ্য পরিচালনার প্রায় সব বিষয়ে সবক দিয়েছেন, খুঁজে দেখি, সেখানে তথ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টিই নেই। কারণ সে যুগে তথ্য অবারিত ছিল না, তথ্যযুদ্ধের বিষয়টিও ছিল অনুপস্থিত। বর্তমানে আমরা বাস করি ইনফরমেশন এজ বা তথ্যের যুগে। এ যুগে রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্য ফ্রন্টগুলোর পাশাপাশি তথ্যকেও একটি ফ্রন্ট হিসেবে দেখতে হবে।
এ যু’দ্ধে উচ্চকণ্ঠ কলরবে সব গ্রহণ বা বর্জনের সুযোগ নেই। তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলারও সুযোগ নেই। অন্য সকল যু’দ্ধের মতো এ ফ্রন্টেও ল’ড়তে হবে তথ্যভিত্তিক যুক্তি ও মেধা দিয়েই। বুঝতে হবে ডিজইনফরমেশন আর ম্যালইনফরমেশনের ককটেল পার্টিরা এখানেই থামবে না বা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে না।
লেখক: মনজুরুল আহসান বুলবুল
সিনিয়র সাংবাদিক।
সূত্র- সময়এখন