ডেস্ক রিপোর্ট: বেশ উৎসাহ নিয়েই দেশে করোনার টিকাদান কর্মসূচি চলছে। প্রতিদিনই বাড়ছে নিবন্ধন ও টিকাগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা। তবে এর উল্টো দিকে এখনো দেশে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ করোনার উপসর্গ নিয়ে ভিড় করছে পরীক্ষার জন্য। আবার উপসর্গ ছাড়াও গড়ে সাড়ে চার হাজারের মতো মানুষ পরীক্ষা করাচ্ছেন বিদেশ যাওয়ার সনদ পেতে। এর মধ্য দিয়ে দিনে এখনো ৩০০-৪০০ মানুষ শনাক্ত হচ্ছে করোনায় আক্রান্ত বলে। প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ এখনো দেশে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত অবস্থায় বা পজিটিভ হয়ে আছে; যাদের মধ্যে দেড় হাজার মানুষ আছে কোনো না কোনো হাসপাতালে। মাঝে দু-এক দিন মৃত্যু পাঁচ-আটজনে নামলেও তা আবার উঠে গেছে ১০ জনের ওপরে। অর্থাৎ বেশির ভাগ সময়ই মৃত্যু ঘুরছে ১০-২০ জনের মধ্যে। এর মধ্যেই বাংলাদেশে ঢুকে গেছে করোনার যুক্তরাজ্য ও আফ্রিকান নতুন ভেরিয়েন্ট বা নতুন বৈশিষ্ট্যবিশিষ্ট করোনাভাইরাস। সর্বশেষ গত মাসেও যুক্তরাজ্যের ওই ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ দেশে পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ আছে নতুন ভেরিয়েন্ট মনিটরিংসহ অন্যান্য সংক্রমণ পরিস্থিতি তুলে ধরা জিআইএসএআইডির ওয়েবসাইটে। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এখন সেই ওয়েবসাইটে নজর রাখছেন সার্বক্ষণিক। যুক্তরাজ্যের ধরনের এই করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কালের কণ্ঠ
এই বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘আমরা যুক্তরাজ্য ভেরিয়েন্টের যে কয়টি রিপোর্ট পেয়েছি সঙ্গে সঙ্গেই ওই রোগীর আশপাশে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছি, যাতে ওই ভেরিয়েন্ট আর না ছড়াতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘সব হয়তো আইইডিসিআর জানার আগেই অন্যান্য গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে জিআইএসএআইডিতে রিপোর্ট করে দেয়। তবে আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক আছি এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। টিকা নিলেই যে আমরা নিরাপদ হয়ে গেলাম, এটা যেন কেউ না ভাবি। টিকাও নিতে হবে, অন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও প্রতিপালন করতে হবে।’
এদিকে নজর রেখেই বিশেষজ্ঞরা বারবার তাগিদ দিচ্ছেন টিকার পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ রোধে অন্য উপায়গুলো কার্যকর রাখার জন্য। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, টিকা নেওয়া মানেই পুরোপুরি নিরাপদ নয়, টিকা নেওয়ার পরও যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন আবার অন্যকেও আক্রান্ত করতে পারেন। তাই টিকা নেওয়া বা না নেওয়া সবারই স্বাস্থ্যবিধি, মাস্ক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব ও বারবার হাত ধোয়ার বিষয়টি মেনে চলতে হবে, যত দিন পৃথিবী থেকে এ ভাইরাস নির্মূল না হবে। এমনকি গত রবিবার রাতে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সভা থেকেও সরকারকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
যদিও আগের তুলনায় দেশে সংক্রমণ ও শনাক্ত অনেক কমে যাওয়ায় বিশেষ করে দৈনিক শনাক্ত হার ২-৩ শতাংশের মধ্যে থাকার বিষয়টিকে দেশ থেকে করোনা নির্মূলের পথে বড় অগ্রগতি বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ আরো কোনো কোনো কর্মকর্তা বিভিন্ন সভা-অনুষ্ঠানে বলছেন।
তবে জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত যতগুলো উপায় বেরিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে টিকা; কোনোভাবেই এটি একমাত্র উপায় নয়। ফলে যতগুলো উপায় আছে সব একসঙ্গেই মানতে হবে, একটি বাদ দিয়ে আরেকটি পালন করলে ফল পাওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্য গবেষণা সংস্থাগুলোও বারবার বলছে, এখন পর্যন্ত যে কয়টি টিকার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো শুধু করোনায় মৃত্যু ও গুরুতর পরিণতি কমাতে সক্ষম, এর বেশি কিছু নয়। অর্থাৎ এই টিকা দিলেই যেকোনো দেশে করোনার সংক্রমণ কমে যাবে বা থাকবে না, এমন কোনো চূড়ান্ত গবেষণা এখনো শেষ হয়নি। কারণ টিকা দেওয়া সবেমাত্র শুরু হয়েছে। এখন গবেষণা চলবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শক ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সংক্রমণের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বেরিয়ে ক্লাস্টার বা গুচ্ছ সংক্রমণ পর্যায়ে রয়েছে। এটা আরো দুই সপ্তাহ থাকলে তখন আমরা পরের ধাপে বা বিচ্ছিন্ন সংক্রমণের পর্যায়ে থাকব। তারপর যদি শনাক্ত শূন্য হয় তখন আমরা দেশে করোনামুক্ত হলেও অন্য দেশে যেহেতু থাকবে সেহেতু আমরাও মহামারির মধ্যেই থেকে যাব। আর মহামারি থাকলেই যেকোনো সময় আমরা আবার সংক্রমণের ভেতরে ঢুকে যেতেই পারি। এমনকি এখনো আবার সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। যেমনটা অন্য অনেক দেশেই এখন দেখা যাচ্ছে। ফলে সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।’
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের দেশে যেহেতু আফ্রিকা ও যুক্তরাজ্যের নতুন ভেরিয়েন্ট পাওয়া গেছে, তাই আমরা এখনো ঝুঁকির মধ্যেই আছি। যদিও ওই ভেরিয়েন্ট এখানে কতটা ভাইরাস ছড়াতে সক্ষম হয়েছে সেটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘যতক্ষণ পৃথিবীর একটি দেশেও করোনাভাইরাস থেকে যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কেউ নিজেদের শতভাগ নিরাপদ ভাবতে পারব না। এ ছাড়া যখন তখন যেকোনোভাবে দেশে যেকোনো ধরনের মিউটেশনের মাধ্যমে পরিস্থিতির আবার অবনতি ঘটতেই পারে। এ বিষয়ে সবার সতর্ক থাকা দরকার।’
ওই বিজ্ঞানী বলেন, যাঁরা টিকা নিয়েছেন তাঁরা যদি ভেবে থাকেন তাঁরা আর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না বা অন্যকে আক্রান্ত করতে পারবেন না, সেটা ভুল। টিকা নেওয়ার পরও যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন এবং অন্যকেও আক্রান্ত করতে পারেন বলে প্রমাণ তো আছেই।
ড. আলমগীর বলেন, টিকা যাঁরা নিয়েছেন আর যাঁরা নেননি তাঁদের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে টিকা নেওয়ার পর তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হলেও গুরুতর কোনো সমস্যা হবে না, তখন তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি কম থাকবে। তাঁদের শরীরে করোনা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে অ্যান্টিবডির কারণে। এ ছাড়া তাঁদের মাধ্যমে অন্যদের কাছে ভাইরাস ছড়ালে সেটাও কিছুটা দুর্বল থাকবে। কিন্তু ছড়ানোর সক্ষমতা থেকেই যাবে। এ ক্ষেত্রে যাঁরা টিকা নেবেন না তাঁরা এসব সুবিধার বাইরে থাকবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত দেশে মোট ৩৮ লাখ ৭৭ হাজার ৮২ জন মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে করোনা পজিটিভ বলে শনাক্ত হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার ৪৩৪ জন। যাদের মধ্যে মারা গেছে আট হাজার ২৯৮ জন ও সুস্থ হয়েছে চার লাখ ৮৮ হাজার ৬২১ জন। বর্তমানে করোনা পজিটিভ হিসেবে আছে ৪৪ হাজার ৫১৫ জন। এর মধ্যে হাসপাতালে আছে এক হাজার ৫৩৪ জন। যাদের মধ্যে শংকটাপন্ন অবস্থায় আইসিইউতে আছে ১৫৭ জন। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালের বাইরে নিজ নিজ বাসায় আছে ৪৩ হাজার ৪৩ জন করোনা রোগী।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট টিকা নিয়েছেন ১৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬১৩ জন। এর মধ্যে গতকাল এক দিনেই টিকা নিয়েছেন দুই লাখ ২৬ হাজার ৯০২ জন মানুষ।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরেক সূত্র জানায়, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত নিবন্ধনের সংখ্যা ২৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।