সুজিত মোস্তফার ফেসবুক থেকে: দীর্ঘ ষোল বছর পর খৃষ্টান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টির প্রধান পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়েছেন জার্মানীর বর্তমান চ্যান্সেলর এ্যাংগলা মেকল (Angela Merkel)। সদস্যদের ভোটে পার্টির নতুন নেতা নির্বাচিত হয়েছেন আমিন ল্যাশেট। আর সেই দিন জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ- এক অদ্ভূত আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। যা সচরাচর রুক্ষ, শীতল, আবেগহীন, ইস্পাত কঠিন জার্মানদের মাঝে সাধারণত দেখা যায়না। নিজ আসন থেকে দাঁড়িয়ে জার্মানরা প্রায় টানা ছয় মিনিট করতালিতে মুখরিত করে রাখে। অনেকের চোখ সেদিন অশ্রুসিক্ত হয়।
একজন পাদ্রীর মেয়ে, কোয়ান্টাম ক্যামিস্ট্রিতে ডঃ ডিগ্রির অধিকারী, রাশান ভাষার পণ্ডিত হিসাবে পুরষ্কৃত, ফ্রান্স, ইংরেজি ভাষায় দক্ষ, ৮৩ মিলিয়ন জার্মানবাসীর নেতা এবং বিশ্বের একজন ক্ষমতাশালী মহিলা এঙ্গলা মেকলের এই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা আসলেই প্রাপ্য ছিলো।
চার ট্রিলিয়ন জিডিপির চালক হিসাবে থেকেও ১ ইউরোর কোনো স্ক্যাণ্ডাল তাঁর নেই। বড় কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স নেই। কোনো প্লেন, ইয়াট, প্লট থাকবে দূরের কথা। যে মার্সিডিজ গাড়ী পুরো দুনিয়ায় বিলাসিতার সিম্বল সেই গাড়িও তাঁর নামে নেই। নতুন পার্টি প্রধান আমিন ল্যাশেট যে দিন নির্বাচিত হন- তাঁর আগমনকে স্বাগত জানিয়ে এ্যাংগেলা মেকেল - বারবার নিজের ভুলগুলোর কথাই বলছিলেন। বলছিলেন- পার্টির প্রধান থেকে যা করার তা হয়তো করতে পারেন নি। সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাগুলোই বারবার তোলে ধরছিলেন। গত ষোল বছরে নতুন জার্মানি তৈরি করবেন- জার্মানীর নব উন্নয়ন ঘটাবেন- একথা একবার না বললেও - গত ষোল বছরে জার্মান অর্থনীতিতে তাঁর দক্ষতায় যোগ হয়েছে -প্রায় দেড় ট্রিলিয়ন ডলার। একে বলেই- সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়লে সে আলোর কথা আর মুখে বলতে হয়না।
শুধুই কি অর্থনীতি। ধর্মীয় সম্প্রীতিতেও তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। হিউম্যান এথিকস ভুলে যাননি-একটি মুহুর্তের জন্য। জানেন, কঠোরভাবে সমালোচিত হবেন- তারপরও পাদ্রীর মেয়ে হয়েও কোরআন পুড়িয়ে দেয়াকে - কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছেন। বলেছেন- ধর্ম সংঘাতের নয়- সহমর্মিতার। টার্কি সফরে গিয়ে বলেছেন- সুখ-দুখে- জার্মান-টার্কি পাশাপাশি থাকবে। ইসলামের সাথে, মুসলমানের সাথে জার্মানের কোনো বিরোধ নেই। তাই, সৌদি মুসলমান ভাইয়েরা যখন - মুসলমান ভাইদেরই মারছে- মেকেল তখন প্রায় ১ মিলিয়ন সিরিয়ান, ইয়েমেন সহ অন্যান্য রিফিউজিদের জন্য বর্ডার খুলে দিয়েছেন। তীব্র সমালোচনার মুখে রিফিউজিদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
২০০৫ সাল থেকে জার্মানীর চ্যান্সেলর থাকার পরও একেবারে সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্ত। নানা সময় সাংবাদিকের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবগুলো থেকেই বুঝা যায়- ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও কি এক সাধারণ জীবন নিষ্ঠা তাঁর। একবার এক প্রেসে কনফারেন্সে মহিলা সাংবাদিক জানতে চাইলো- বছরের পর বছর এই সাদামাটা পোষাকে আপনাকে দেখছি। আপনার কি আর কোনো পোষাক নেই?
মেকেল হেসে বলেন- আমিতো কাজ করতে এসেছি। একজন সরকারের চাকর। মডেল না। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে এসেছি , বিউটি কম্পিটিশানেতো আসিনি। ′′ I am a government servant, not a model ". আরেকজন জিগ্যেস করলো- ও আচ্ছা। পোষাক না হয় নাই বদলালেন। গৃহস্থালী কাজ, খাবার রান্না- এসবের জন্য নিশ্চয়ই অনেক কাজের লোক আছে। না, কোনো কাজের লোক নেই এবং দরকারও নেই। আমি আর আমার স্বামী ঘরের যাবতীয় কাজ করি।
তাহলে আপনার পোষাক কে পরিষ্কার করে দেয় ?
তাও নিজেরা করি। আর বেশি পোষাক নাই বলে। বেশি কাপড় ধোঁয়ার ঝামেলাও নেই। জীবন যত সাধারণ। জীবন তত শৃঙখলার। সপ্তাহে একদিন আমি সব ময়লা কাপড় একজায়গায় করে মেশিনে দেই। আর ধোঁয়া, শুকানো হয়ে গেলে আমার স্বামী সব কাপড় ভাঁজ করে রাখেন। আর লন্ড্রি মেশিনের কাজগুলো বড়জোড় রাত নটার আগেই শেষ করার চেষ্টা করি। যাতে প্রতিবেশী বা অন্য কারো ঘুমের কোনো সমস্যা না হয়।
একের পর এক যখন তাঁর দৈনন্দিন, ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন আসছে মেকেল তখন বলেন- আসলে আপনাদের উচিত -এসব বিষয়ে না জেনে- সরকারের পারফরম্যান্স বিষয়ে জানা। ′′ I think you guys better pay attention to my government performance ".
তাঁর একটা জিনিস এতো ভালো লেগেছে- শেয়ার না করে পারছিনা। পুটিন জিগ্যেস করেছিলেন- কেন তার পোষা কোনো কুকুর নেই?
মেকেল তাঁর বাবা হস্ট কাসনের একটা ঘটনা বলেন। খাবার পর বাবা কুকুর নিয়ে বের হয়েছেন। দেখেন- রাস্তায় এক হোমলেস মানুষ আর তার সন্তান ( মনে হয়) শুয়ে আছে। হয়তোবা ওরা রাতে খেয়েছে অথবা খায়নি। কে জানে। বাবার মনটা এই ঘটনায় খুব কাতর হয়। ভাবলেন- এ কেমন পৃথিবী।
যে পৃথিবীতে এক পিতা তার সন্তানকে নিয়ে না খেয়ে পথের ধারে ঘুমায় - সেখানে কুকুর পোষা মানুষের বিলাসীতা ছাড়াতো আর কিছুই নয়। বাবাও বিলাসীতা করেন নি। বাবার মেয়ে হয়ে- আমিও আর বিলাসীতার পথে পা বাড়াইনি। মেকেল বলেন- সেই জন্য কুকুরও মনে হয় আমাকে খুব পছন্দ করেনা। ৯৫ সালে মেকেলকে কুকুরে কামড়ে দেয়।
গত বিশ বছর যাবত তিনি একই ফ্লাটে বাস করে আসছেন। শুধু তাই নয় - গত পনের বছর যাবত জার্মানীর চ্যান্সেলর থাকার পরও তাঁর ঠিকানার কোনো পরিবর্তন নেই । একই এ্যাড্রেস গত বিশ বছর ধরে ব্যবহার করে আসছেন। ছোট এই ফ্লাটে কোনো সুইমিং পুল নেই, অবসর যাপনের আলাদা হাউস নেই, দূর্নীতির টাকায় করা কোনো বাগান বাড়ি নেই, ঘুষের টাকায় শখের কোনো হরিণও নেই, এমনকি একটা পোষা কুকুরও নেই।
কিন্তু যে জিনিসটা তিনি পেয়েছেন- সেটা হলো মিলিয়ন মানুষের ভালোবাসা আর গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে শ্রদ্ধা। তাই, গত পনের জানুয়ারী তিনি এক বিরল ঘটনা ঘটিয়েছেন। যা জার্মানরা করেনা তাই করেছে। ইস্পাত কঠিন জার্মানবাসী আসন থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে শুধু শ্রদ্ধাই জানায়নি। কয়েক মুহুর্তের জন্য তারা অশ্রুসিক্ত হয়েছে।
লিখেছেন : Arif Mahmud