শিরোনাম
◈ কিছুটা কমেছে পেঁয়াজ ও সবজির দাম, বেড়েছে আলুর ◈ দেশের ৯২ শতাংশ মানুষ দ্বিতীয় কোনো ভাষা জানেন না, সময় এসেছে তৃতীয় ভাষার ◈ ভুটানের রাজার সঙ্গে থিম্পু পৌঁছেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ◈ চট্টগ্রামের জুতার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে ◈ জিয়াও কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেনি, বিএনপি নেতারা যেভাবে করছে: ড. হাছান মাহমুদ ◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫

প্রকাশিত : ৩১ জানুয়ারী, ২০২১, ১১:৩২ দুপুর
আপডেট : ৩১ জানুয়ারী, ২০২১, ১১:৩২ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

[১] আমার প্রথম টেস্ট, ভারত-ইংল্যান্ড, কলকাতা, ১৯৯৩

উৎপল শুভ্র : [২] আমার ক্ষেত্রে দুটি উপলক্ষই মিলেমিশে একাকার। 'প্রথম' যেকোনো কিছুই বিশেষ। জীবনের প্রথম টেস্ট ম্যাচও তা-ই। প্রায় ২৮ বছর হতে চলল সেই অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার।

[৩] কী সাদাসিধেই না ছিল তখনকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট! গলায় ঝোলানো অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডের চল তখনো শুরুই হয়নি। ক্রিকেট বোর্ডেরও এত খবরদারি ছিল না। ইডেন গার্ডেনের টেস্ট ম্যাচে সাংবাদিকদের প্রেসবক্সে প্রবেশাধিকার দেওয়ার দায়িত্ব ছিল যেমন সেই শহরের ক্রীড়া সাংবাদিক অ্যাসোসিয়েশনের। টেস্টের পাঁচ দিনের জন্য পাঁচটি টিকিট। এখন অমূল্য মনে হওয়া অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও এটা কীভাবে যেন এখনো রয়ে গেছে আমার কাছে। একটু ছিঁড়েটিড়ে যাওয়ায় যা বেশ একটা ঐতিহাসিক দলিলের ভাবও নিয়েছে। এ কারণেই লেখার সঙ্গে তা জুড়ে দেওয়া। প্রথম টেস্ট ম্যাচ এমনই এক স্মৃতি, শত রোমন্থনেও যা একই রকম মধুর লাগে। আপনারও তা লাগবে বলে আশা করি না। তবে সময় থাকলে পড়ে তো একটু দেখতেই পারেন।

[৪] পরিচয় দিয়ে হাত বাড়িয়েছি, হ্যাঁচকা টান মেরে জড়িয়ে ধরলেন গ্রাহাম গুচ। ছয় ফুটের ওপর লম্বা ইংল্যান্ড-অধিনায়ক। তাঁর ঘামে ভেজা দীর্ঘ শরীরের বজ্র-আঁটুনিতে আমার হাঁসফাঁস অবস্থা। বজ্রমুষ্টি যদি হয়, তা হলে বজ্র-আলিঙ্গনও যে হতে পারে, সেটাও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আ মোলো, একি যন্ত্রণা!

[৫] কোনোমতে গুচের হাত থেকে মুক্তি পেতেই হাত বাড়িয়ে দিলেন পাশে দাঁড়ানো ইংল্যান্ড-কোচ কিথ ফ্লেচার। ‘আরে, আপনিই উৎপল শুভ্র! আপনার লেখা নিয়মিত পড়ি। আচ্ছা, আপনি ইংরেজিতে লেখেন না কেন? আপনার লেখা পড়ব বলে একজন অনুবাদক রাখতে হয়েছে। কিন্তু আপনিই বলুন, অনুবাদে কি আর আসল লেখার মজা পাওয়া যায়?’ হড়বড় করে বলে গেলেন সাবেক ইংল্যান্ড-অধিনায়ক।

[৬] ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের অধিনায়ক-কোচের এমন উচ্ছ্বাসে আমার রোমাঞ্চিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমার যে কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না। ‘হতভম্ব’ শব্দটাতে কি অনুভূতি বোঝায়? তা যদি হয়, তা হলে কাজ করছে। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ফ্লেচারকে বললাম, ‘আমি ইংরেজিতে লিখতে যাব কোন দুঃখে? জানো না, আমরা বিশ্বে একমাত্র জাতি, যারা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি? তুমি বরং বাংলা শিখে নাও।’

[৭] পরের লাইনটা কী হবে, এটা বোধ হয় আপনি অনুমান করে ফেলেছেন। মা/বাবা/ভাই/বন্ধু—কারও ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল, এটাই তো হওয়া উচিত, তাই না? সেই উচিত কাজটাই হচ্ছে না, কারণ এটা কোনো স্বপ্নদৃশ্য নয়। সত্যিও যে নয়, সেটিও কি বলতে হবে? ওপরে যা পড়লেন, তা পুরোপুরি বানানো গল্প। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বানানোই। আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে; তবে সত্যি বলছি, গুচ-ফ্লেচার জীবনেও আমার কোনো লেখা পড়েননি। এমনকি আমার নামও শোনেননি।

[৮] তা হলে এই ফাজলামির অর্থ কী? ভাই রে, এটা যদি ফাজলামি বুঝে ফেলে থাকেন, তা হলে আবার অর্থ খুঁজতে যাচ্ছেন কেন? ফাজলামি তো ফাজলামিই, অর্থবোধক ফাজলামি বলে কিছু আছে নাকি! তার পরও অর্থের ব্যাপারে যদি নাছোড়বান্দাই হন, তা হলে ঘটনাটা খুলেই বলি। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে জীবনের প্রথম টেস্ট ম্যাচ কাভার করতে কলকাতা যাচ্ছি। গুচ-ফ্লেচার নিয়ে ওপরে যা পড়লেন কলকাতা যাওয়ার আগে আমার সে সময়ের কর্মক্ষেত্র ভোরের কাগজ-এর সহকর্মীদের ফাজলামি করেই বলে গিয়েছিলাম, আমার পাঠানো প্রথম রিপোর্টটা হবে এ রকম।

[৯] ইংরেজিতে একটা শব্দই ‘তুই’, ‘তুমি’, ‘আপনি’ সব কটার প্রকাশক। আমাকে বলা ফ্লেচারের ‘ইউ’ শব্দটার ঠিকই ‘আপনি’ অনুবাদ করলাম, আর আমি বলার সময় ‘তুমি’ কেন এই প্রশ্ন করবেন তো! ইংরেজিভাষী কারও সঙ্গে কথা বলার সময় ‘ইউ’টা কেন যেন ‘আপনি না হয়ে তুমি-তুমি লাগে! সবার ক্ষেত্রেই তা হবে, এমন তো কথা নেই। আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরুর সময়কার সহকর্মী ফরহাদ টিটোর কথা মনে পড়ছে।

[১০] ‘তুমি-ও নয়, ওনার কাছে ‘ণড়ঁ’ শব্দের একটাই অর্থ ছিল তুই! একটা উদাহরণ দিই। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ঢাকায় শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা ঝাঁকে ঝাঁকে খেলতে আসতেন। টিটো ভাই অফিসে ফিরে আবাহনী না মোহামেডানে খেলতে আসা এমনই এক শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারের সঙ্গে কথোপকথনের বর্ণনা দিচ্ছেন। দ্বিপক্ষীয় কথাবার্তার বদলে আমি বরং শুধু টিটো ভাইয়ের অংশটুকুই তুলে দেই।

[১১] ‘হালারে দেইখা একদমই ইমপ্রেসিভ লাগে না। আমি জিজ্ঞেসও করলাম, তুই শ্রীলঙ্কায় কোন লেভেলে খেলছস্? উইকেট-টুইকেট কিছু পাইছস?’
‘তুই যে আইছস, ঢাকা লিগে তো পেসারদের ভাত নাই। তুই কি কিছু করতে পারবি?’
‘এখানে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার দর্শক হয়। এত দর্শকের সামনে খেলছস্ কোনো দিন?’
‘আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে তো অনেক প্রেশার। তুই পারবি?’

[১২] টিটো ভাই অনেক দিনই কানাডা-প্রবাসী। কিছুদিন আগে দেশে এসেছিলেন, একটুও বদলাননি। কানাডার কোনো বড় মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়ার গল্পটাও একইভাবে করলেন"ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই কি কোনো দিন বাংলাদেশে গেছস্’?”

[১৩] আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যখন প্রথম কাভার করতে শুরু করি, এই প্রশ্নটা আমিও সব ক্রিকেটারকেই করতাম। তবে আমার ‘ইউ’টা ‘তুমি’র নিচে নামত না। কিথ ফ্লেচারকেও প্রশ্নটা করেছিলাম। তবে ‘পাত্র’ ঠিক থাকলেও স্থান-কালে একটু ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল। টেস্ট ম্যাচের আগের দিন সকাল-সকাল ইডেন গার্ডেনে পা রেখে আমি তো রীতিমতো রোমাঞ্চিত। সেই ছেলেবেলা থেকে এই মাঠ নিয়ে কত পড়েছি, কত কী শুনেছি! সেই মাঠে টেস্ট অভিষেক হচ্ছে আমার! টেস্ট অভিষেকই তো! ক্রিকেটারদের যদি টেস্ট অভিষেক হতে পারে, সাংবাদিকের কেন নয়? শুধু তো সাংবাদিকের ভূমিকায় নয়, দর্শক হিসেবেও আমার প্রথম টেস্ট ম্যাচ। জর্জ বার্নার্ড শর কথাও খুব মনে পড়ছে। তাঁর সঙ্গে আবার কবে পরিচয় হলো? না, বার্নার্ড শর সঙ্গে পরিচয় হয়নি, তবে টেস্ট ম্যাচ নিয়ে তাঁর একটা অমর বাণীর সঙ্গে পরিচয় আছে।

[১৪] একদিন লর্ডসের দিকে মানুষের ঢল দেখে বার্নার্ড শ একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার? এরা সবাই যাচ্ছে কোথায়?’

[১৫] ‘কেন, আপনি জানেন না! লর্ডসে। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডের টেস্ট।’শুনে বার্নার্ড শ খুবই বিরক্ত,‘হোয়াই? হোয়াই দে আর টেস্টিং আস্?’ মাঠের দু প্রান্তে দু দল নেট প্র্যাকটিস করছে। কিথ ফ্লেচার আম্পায়ার যেখানে দাঁড়ায়, সেখানে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ম চোখে রবিন স্মিথের ব্যাটিং দেখছেন। দেশের বাইরে প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট, বাড়তি কিছু করার উত্তেজনায় আমি ভাবলাম, ফ্লেচারের সঙ্গে আগেই একটু কথা বলে ফেলি। মাঠে ঢুকে ফ্লেচারকে গিয়ে বললাম,‘হাই, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সাংবাদিক।’ইংলিশ ভদ্রতার পরিচয় দিয়ে ফ্লেচার বললেন,‘নাইস টু মিট ইউ।’একাদশ কি ঠিক হয়ে গেছে? জিজ্ঞেস করার পর অবশ্য ‘নাইস-টাইস’ উধাও। রাগত স্বরে ফ্লেচার বললেন,‘এখন প্র্যাকটিস হচ্ছে। যা বলার পিসিতে বলব।‘

[১৬] ‘পিসি’ মানে যে প্রেস কনফারেন্স, সেটি তখনো জানি না। ফ্লেচারকেই জিজ্ঞেস করব কি না ভাবছি, দৌড়ে এলেন প্রবীর মুখার্জি। ইডেনের পিচ কিউরেটরের সঙ্গে সকালেই আলাপ হয়েছে। আমার হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিতে নিতে উষ্মার সুরে বললেন, ‘দাদা, কী করছেন আপনি? প্র্যাকটিসের মধ্যে ঢুকে গেছেন! এর আগে উইকেটের কাছেও ঘুরঘুর করছেন দেখলাম। আপনার উদ্দেশ্য কী, বলুন তো?’

[১৭] উদ্দেশ্য তো অবশ্যই মহৎ। কিন্তু সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড (তখন অবশ্য এই কার্ডের চলই শুরু হয়নি) যে যেখানে খুশি যাওয়ার স্বাধীনতা নয়, সেটি জানলে তো! প্রবীর মুখার্জি যে উইকেটের কাছে ঘুরঘুর করার কথা বললেন, সেটি ঘণ্টাখানেক আগের কথা। গুচ আর ফ্লেচার উইকেট দেখতে গেছেন। আমি ভাবলাম, উইকেট দেখে তাঁরা কী বুঝলেন, সেটি তাৎক্ষণিকভাবে জেনে নিলেই তো হয়। ওদের পেছন পেছন আমিও তাই চলে গেলাম উইকেটের কাছে। উইকেট টিপেটুপে দুজন কী যেন বলছেন, দুর্বোধ্য ইংরেজির কারণে ঠিক বুঝতে পারছি না।

[১৮] গুচকে তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘উইকেট কেমন বুঝছেন?’
গুচ উত্তর দিলেন,‘আমার শরীর ভালো নেই।’
মাঠে এসেই শুনছিলাম গুচের নাকি জ্বর। তাই বলে উইকেট কেমন? এই প্রশ্নের সঙ্গে জ্বরতপ্ত শরীরের কী সম্পর্ক তা বুঝতে না পেরে আমি যারপরনাই অবাক। আরও অবাক হলাম পিসি অর্থাৎ প্রেস কনফারেন্সের সময়। বসা-টসার কোনো ব্যবস্থা নেই। ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতে কোমর-উচ্চতার কাঠের রেলিংয়ের ওপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন কোচ-অধিনায়ক, আর এ পাশে ধাক্কাধাক্কি করে যতটা সম্ভব কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন পঁচিশ-ত্রিশজন সাংবাদিক। স্কুলজীবনে সিনেমার টিকিট কাটার ব্যাপারে আমার এক বন্ধুর বিশেষ বুৎপত্তি ছিল। কীভাবে কীভাবে যেন এর-ওর পায়ের ফাঁক দিয়ে ও ঠিক কাউন্টারের সামনে চলে যেত। টেস্ট ম্যাচ কাভার করতে এসে যে ওই বিদ্যাটা না শেখার জন্য আফসোস হবে, এটা কোনো দিন কল্পনাও করিনি।

[১৯] তবে চেষ্টা করলে যে সবই হয়, এটা প্রমাণ করে এর ধাক্কা, ওর কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে এবং কিছু কিছু ফিরিয়ে দিয়ে আমি মোটামুটি সামনেই চলে গেলাম। কিন্তু গিয়ে লাভ কী, গুচ- ফ্লেচার যে হিব্রু ভাষায় কথা বলছেন! বলছেন ইংরেজিই, কিন্তু জানা না থাকলে আমার তা বোঝার সাধ্য ছিল না।

[২০] ধাক্কাধাক্কি-পর্ব শেষ হওয়ার পর বাধ্য হয়ে তাই শরণাপন্ন হলাম এক ইংরেজ সাংবাদিকের। ও মা, এ তো দেখছি গুচ-ফ্লেচারের বাবা! ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে প্রবাদটার অর্থও সঙ্গে সঙ্গে পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করে ফেললাম। নামটা আগেই জেনে নিয়েছিলাম টেড করবেট। অনেক বছর পর ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। ততদিনে ইংলিশদের বাচনভঙ্গির সঙ্গে একটু পরিচয় হওয়ায় কথাবার্তাও ভালোই বুঝেছি। কিন্তু ইডেন গার্ডেনে টেড করবেটের সঙ্গে ওই প্রথম পরিচয়ের অভিজ্ঞতা এখনো ভুলতে পারি না। এখন যেমন কারও ইংরেজি বুঝতে না পারলে নির্দ্বিধায় তা বলে ফেলতে পারি, তখন তো আর এই আত্মবিশ্বাস নেই। গুচ-ফ্লেচারের কথা বুঝতে পারিনি বললে যদি আমার ইংরেজিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, করবেটকে তাই বললাম, ‘ওরা কী বলল, ধাক্কাধাক্কিতে ঠিকমতো শুনতে পাইনি। একটু যদি বলতেন!’

[২১] টেস্ট ম্যাচ কাভার করছেন বাংলাদেশি সাংবাদিক ব্যাপারটা তখন এমনই ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর মতো ছিল যে, ইডেনে পা রাখার পর থেকেই বাড়তি সমাদর মিলছে। টেড করবেটও বেশ কবার ‘ফ্রম বাংলাদেশ! ভেরি গুড, ভেরি গুড’ বলে নোটবুক খুলে সোৎসাহে বলতে শুরু করলেন, গুচ-ফ্লেচার কী বলেছেন। উনি বলছেন, আর আমি ‘ইয়া’ ‘ইয়া’ (সকালে মাঠে গিয়েই এটা নতুন শিখেছি) করে আমার নোটবুকে লেখার ভান করছি। ঠিক ভান নয়, আসলেই লিখছি। জীবনের প্রথম টেস্ট ম্যাচের স্মৃতি বলে নোটবুকটা এখনো রেখে দিয়েছি। কী লিখছিলাম, তার নির্বাচিত অংশ তাই তুলে দেওয়া যাচ্ছে—

[২২] ‘এই গাধা, তুই এটা কী ভাষায় কথা বলছিস! ইংরেজি বলতে পারিস না?’
‘তোদের সমস্যাটা কী, ইংরেজ হয়েও ভালোমতো ইংরেজি বলতে পারিস না ক্যান?’
‘গুচ বলেছে, এই টেস্টে হারলে তোরে একটা থাপ্পড় দেবে।’

[২৩] ‘তোর মাথা!’
মুদ্রণযোগ্য এটুকুই পেলাম। আর যা যা আছে, সেসব ছাপার অক্ষরে খুব শোভন দেখাবে না।

[২৪] প্রথম টেস্ট কাভার করার কথা ভাবলে টেড করবেটের মুখটা এখনো চোখে ভাসে। আর ভাসে আরেক টেড, টেড ডেক্সটারের মুখও। ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক, অভিজাত পরিবারের সন্তানের ব্যাটিংয়েও ছিল আভিজাত্যের ছাপ। ওই কলকাতা টেস্টের সময় অবশ্য তাঁর বড় পরিচয় ইংল্যান্ডের প্রধান নির্বাচক। যে পরিচয়ের কারণেই আমার চোখে রীতিমতো ভিলেন। ডেভিড গাওয়ারকে যে বাদ দিয়ে দিয়েছেন দল থেকে! কলকাতায় টেস্ট কাভার করতে যাব, এটা ঠিক হওয়ার পর আমার চাওয়া বলতে ছিল দুটি, ম্যাচে যা ইচ্ছে হোক, দু দলের দুই ব্যাটসম্যানের বড় দুটি ইনিংস দেখতে চাই। একজন ডানহাতি, অন্যজন বাঁহাতি। কিন্তু দুজনের বড় মিল, তাঁদের ব্যাটিংয়ে শক্তির প্রকাশ একেবারেই প্রচ্ছন্ন। বরং তা চোখে বুলিয়ে দেয় স্বপ্নের মায়াঞ্জন। মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন ও ডেভিড গাওয়ার।

[২৫] ১৮২ রানের অপূর্ব এক ইনিংস খেলে আজহারউদ্দিন আমার প্রত্যাশার অর্ধেকটা মিটিয়েছিলেন। বাকি অর্ধেকটা মেটার উপায় ছিল না, কারণ ডেভিড গাওয়ার দল থেকে বাদ পড়ে ওই টেস্টে টিভি কমেন্টেটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তখন বয়স কম, আবেগে টইটুম্বুর। টেস্টের মাঝখানে একদিন টেড ডেক্সটারকে পেয়ে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়াটাও সে কারণেই। ঢাকায় টেস্ট খেলেছেন বাংলাদেশের সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে হাসিমুখে সেই স্মৃতিচারণা করলেন ডেক্সটার। কিন্তু ডেভিড গাওয়ার কেন দলে নেই এই প্রশ্ন করতেই সেই হাসি উধাও। ইংল্যান্ডেও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জেরবার হয়ে গেছেন বলে এমনিতেই এ ব্যাপারে স্পর্শকাতর হয়ে আছেন। আর বাংলাদেশের এক সাংবাদিক যে শুধু প্রশ্ন করেই থামছেন না, গাওয়ারের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের পরিসংখ্যান-টরিসংখ্যানকে অস্ত্র করে রীতিমতো জেরা করতে শুরু করেছেন তাঁকে! ‘আমি আপনাকে আমাদের সিলেকশন পলিসি ব্যাখ্যা করতে বাধ্য নই’এ কথা বলার পরও আমি নিরস্ত নই দেখে ডেক্সটার রেগেমেগে লাল হয়ে বলে ফেললেন. ‘তা হলে ইংল্যান্ড দল নির্বাচনের দায়িত্বটা আপনিই নিন না কেন!’

[২৬] টেড ডেক্সটারকে তখন কী বলেছিলাম, মনে নেই। তবে এখন এই কথা বললে আমি কী জবাব দিতাম, তা অনুমান করতে পারি।
ধুর, আমার এত সময় আছে নাকি! - ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়