মাসুদ রানা : সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রণ্ট প্রতিষ্ঠা-কালে কেন্দ্রীয় কমিটীতে আমরা কয়েকজন সম্মত হয়েছিলাম যে, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রণ্ট হবে একটি socialistic popular democratic student organisation (সমাজতন্ত্রমনা জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন), যা ছাত্রদের অধিকার নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও জাতীয় অঙ্গনে সংগ্রাম করবে শিক্ষা ও শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত স্থানীয় ও জাতীয় ইস্যু নিয়ে; আর, এ-সংগ্রামের পথে যারা শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী জীবন বেছে নেবেন, তাঁরা পার্টিতে যোগ দেবেন কিন্তু ফ্রণ্টকে পার্টি বানাবেন না। পরিতাপের বিষয়, আমাদের ধারণাকে ‘স্বায়ত্ব শাসন’ নামে অভিহিত করে এর বিরুদ্ধে পার্টি থেকে রূপতঃ কামান দাগানো হয়, এবং এতে প্রথম ‘শহীদ’ হন ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে স্বপদে বহাল থাকা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রণ্টের প্রথম সাধারণ সম্পাদক আ ক ম জহিরুল ইসলাম, যাঁর উচিত ছিলো পরবর্তী সম্মেলনে সভাপতি হওয়া, কিন্তু তাঁকে তা হতে দেওয়া হয়নি।
আসলে, জহিরুল ইসলামের সভাপতি হওয়ার কথা ছিলো অভিন্ন বাসদ-আমলেই। কিন্তু সে-সময় বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটী থেকে মাহমুদুর রহমান মান্নার অব্যহতি-দান নিয়ে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ১৯৮৩ সালের ২৯ শে মার্চে অনুষ্ঠিত ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে পূর্বের ধারণার বিপরীতে আখতারুজ্জামানকে প্রেসিডেণ্ট হিসেবে আনা হয়, যদিও ভৌটে দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠার কারণে জহিরুল ইসলমাই কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হতেন। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রণ্ট স্বঘোষিতভাবেই বাসদের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে বিকশিত হয় এবং এর নেতৃত্ব সব-সময়েই বাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দ্বারা নির্ণীত হয়েছে। ফলে, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফণ্ট সমাজতান্ত্রিক হলেও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি।
আমরা যাঁরা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রণ্টের প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম, তাঁদের মধ্যে স্পিরিট ছিলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সহযোগী শক্তি হওয়ার, বিপ্লবী হওয়ার নয়, আর এ-উদ্দেশেই আমরা ‘আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ বাদ দিয়ে শুধু ‘ঐক্য সংগ্রাম প্রগতি’ রাখি।কিন্তু অচিরেই ছাত্র ফ্রণ্টের মধ্যে ‘দলই জীবন, বিপ্লবীই জীবন, এই চেতনায় দল গড়ুন’ স্লৌগান উত্থিত হয় এবং বাসদের কাছে এই স্লৌগান- দেওয়া বিপ্লবীর ‘বিশ্বস্ত’ হয়ে উঠেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যাল্যের কলাভবনের ১০২২ নং রুমে ছাত্র ফ্রণ্টের পাঠচক্রে পার্টি- নেতারা এসে ‘কারা কারা পেশাদার বিপ্লবী হতে চাও?’ প্রশ্ন করে হাত তুলতে বলেন। সে-পাঠচক্রে যাঁরা তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকেই পরবর্তী ছাত্র ফ্রণ্টের শীর্ষ নেতৃত্ব আসে। আমার মনে আছে, হাত না- তোলার দলে আকম জহিরুল ইসলাম ও আমি ছিলাম না। যাঁরা পেশাদার বিপ্লবী হতে চেয়েছিলেন, তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিলো এবং তাঁদের নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বিদ্রোহীদের আমি অনেক প্রয়াস দিয়ে দমিত রাখি।
১৯৮৭ সালে কেন্দ্রীয় কমিটীর সাংগঠনিক সম্পাদক থাকা কালেই আমি বুঝতে পারি, বাসদের একজন সমর্থক হওয়া ছাড়া আমার জন্যে অন্য কোনো স্থান নেই। তাই, লণ্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে পড়তে এসে আমি ১৯৯১ সালে ‘বাসদ সমর্থক ফোরাম’ নাম একটি সংগঠন গড়ে তুলি জীবনের প্রথম উপার্জিত আয়-সহ মাসিক হারে নিয়মিত অর্থ সহায়তা দিতে থাকি। যুক্তরাজ্যে বাসদ সমর্থক ফোরামের প্রতিষ্ঠা অনুসরণে কয়েকটি দেশে একই নামে সংগঠন গড়ে এবং শেষপর্যন্ত বাংলাদেশেও শক্তিশালী ফোরাম গড়ে ওঠে। বাসদ সমর্থক ফোরাম ছিলো বাসদের রাজনীতিতে আমার সাংগঠনিক-ধারণাগত মৌলিক অবদান, যা এসইউসি ট্র্যাডিশনের বাইরে একমাত্র বৈশিষ্ট্য। ২০১৩ সালে বাসদের দ্বিতীয় বিভক্তি-কালে আমি বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সদস্য মবিনুল হায়দার চৌধুরী কাছে একটি চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলাম দলটি না-ভাঙ্গার এবং বলেছিলাম তাঁরা যদি ভেঙ্গে ফেলেন, আমার পক্ষে এর কোনো অংশকেই সমর্থন করা সম্ভব হবে না। সেই থেকে আমি আর বাসদের সমর্থকও নই। তবে, জাসদের প্রতিষ্ঠাকালে মানসিকভাবে এবং বাসদের প্রতিষ্ঠাকালে শারীরিকভাবে ছিলাম বলে এ-দু’টি দলের লোকদের প্রতি এক প্রকারের আত্মীয়তা বোধ করি। এমনকি, এখনও পর্যন্ত সমাজতন্ত্র চাই বলে সমাজতন্ত্র চাওয়া প্রতিটি দলের সদস্যদেরকেও আপন মনে করি। পরিশেষে, আমি কোন দল বা মতবাদের সমর্থক নই। আমার কোনো দল নেই, আমার কোনো ইজম নেই। আমার আছে লক্ষ্য মানুষের সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত মুক্তি, আমি বুঝি করণীয় – মুক্তি লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি। ২১/০১/২০২১লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড। ফেসবুক থেকে