সোহেল রহমান: [২] করোনাকালীন সময়ে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের রেকর্ড পরিমাণ উল্লম্ফনে সম্ভাব্য ছয়টি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছে বেসরকারি সংস্থা ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম’। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে করোনাকালীন সময়ে আয় কমে যাওয়া ও চাকরির অনিশ্চয়তার কারণে প্রবাসীদের পরিবারের চাহিদা বৃদ্ধি; করোনাকালীন সময়ে হুন্ডি তৎপরতা কমে যাওয়ায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি; সরকার কর্তৃক ২ শতাংশ প্রণোদনা প্রদানের ইতিবাচক প্রভাব; কোনো ডকুমেন্ট ছাড়া ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রেরিত রেমিট্যান্স প্রণোদনার আওতায় আনা (আগে এই সীমা ছিল দেড় লাখ টাকা); রেমিট্যান্স সরবরাহের ক্ষেত্রে বিকাশসহ অন্যান্য মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস অপারেটরদের ১ শতাংশ অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ প্রদান এবং হজ্ব না হওয়ার কারণে হজ্বের জন্য জমিয়ে রাখা অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেয়া ইত্যাদি।
[৩] সোমবার ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম’ আয়োজিত ‘সাম্প্রতিক রেমিট্যান্স প্রবাহ : এত টাকা আসছে কোথা থেকে’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংলাপে এসব কারণ তুলে ধরা হয়। সংলাপে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ’ (সিপিডি)-এর সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
[৪] মূল প্রতিবেদনে রেমিট্যান্স প্রবাহের রেকর্ড পরিমাণ উল্লম্ফনের ছয়টি কারণ তুলে ধরার পাশাপাশি যেসব দেশ বা গন্তব্য থেকে সাধারণ সময়ে গড় রেমিট্যান্স প্রবাহের তুলনায় অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স এসেছে সেখানকার রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের আয়ের উৎস এবং বিদ্যমান আইন যথাযথ প্রয়োগ করা হলে প্রেরিত রেমিট্যান্সের সম-পরিমাণ অর্থ পাঠানো সম্ভব হতো কি না এ বিষয়টি সরকারের গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। অন্যদিকে যেসব দেশ থেকে প্রবাসীরা সাধারণ সময়ের তুলনায় অধিক রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, রেমিট্যান্স প্রেরণের ক্ষেত্রে ওইসব দেশের কোনো আর্থিক সীমা আছে কি না এবং করোনাকালীন সময়ে তা শিথিল করা হয়েছে কি না এটিও একটি প্রশ্ন।
[৫] প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালীন সময়ে গত ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহের পরিমাণ প্রায় ২২ দশমিক ১ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল। কিন্তু এটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের গড় প্রবাহের পরিমাণ জিডিপি’র ৭ দশমিক ১ শতাংশ। গত বছর (২০২০ সাল) এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির হার ৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর পাকিস্তানে রেমিট্যান্স প্রবাহ দাঁড়িয়েছে জিডিপি’র ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কার ৪ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ।
[৬] প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহের ঊর্ধ্বগতি সরকারের কাছে ছিল একটি বড় ধরনের স্বস্তি। এর ফলে করোনাকালীন সময়ে প্রবাসীদের পরিবারগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী আর্থিক সরবরাহ বেড়েছে। এছাড়া বৈদেশিক রিজার্ভ, অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। তবে অতিরিক্ত রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে চলতি অর্থবছরে প্রণোদনা বাবদ সরকারকে আরও ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা অধিক ব্যয় করতে হতে পারে। চলতি বাজেটে এ খাতে ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে এর ৭০ শতাংশ ব্যয় হয়ে গেছে।
[৭] প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১৬-২০২০) বছরওয়ারি রেমিট্যান্স আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, কোনো বছরই সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। পাঁচ বছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় গড় ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। যদি চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট ছয় মাস রেমিট্যান্স প্রবাহের একই ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা (২,৫৪০ কোটি ডলার) অর্জিত হতে পারে।
অন্যান্যের মধ্যে প্রতিবেদনে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের তথ্য তুলে ধরে অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এটি একটি অন্যতম সূচক।
[৮] সংলাপে অংশ নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, প্রবাসী আয়ের ওপর সরকারি ২ শতাংশ প্রণোদনা যদি আরও কিছুটা বাড়ানো যায়, তবে এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে। ইতোমধ্যেই ফিরে আসা বাংলাদেশিদের জন্য ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এ তহবিল থেকে চার শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ দেয়া হবে।
[৯] ‘সেন্টার ফর নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশি’ (এনআরবি)-এর চেয়ারপার্সন এমএস শেকিল চৌধুরী বলেন, একটি সময় হুন্ডির মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ অর্থ দেশে আসত। আবার প্রবাসীরা প্রতিবছর দেশে আসার সময় অনেক ক্যাশ টাকা আনতেন। এখন সেটার প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠালে ২ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। এছাড়া যেসব ব্যবসায়ী হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন করতেন, তাদের মধ্যেও বৈধ পথে টাকা লেনদেনের আগ্রহ বেড়েছে।
[১০] ‘রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটিং মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট’ (রামরু)-এর চেয়ারপার্সন অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি মানে প্রবাসীরা ভালো আছেন এটা ভাবা উচিত নয়। তবে যেসব প্রবাসী ইতোমধ্যেই কাজ হারিয়ে দুরবস্থার মধ্যে রয়েছেন, তাদের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত।
[১১] সমাপনী বক্তব্যে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পরিশ্রমী এসব মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে সমস্যায় পড়বে বাংলাদেশ। কারণ কর্মসংস্থানের ওপর ভিত্তি করেই বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি অর্জন নির্ভর করছে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে যে ২০০ কোটি টাকা বিতরণ কার্যক্রম নেয়া হয়েছে এর মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। নানা অসুবিধার কারণে প্রবাসীদের কাছে টাকা পৌঁছাতে পারছে না তারা। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কেন অন্য কোনো শিডিউল ব্যাংকের মাধ্যমে এই ঋণ বিতরণ করা হবে না। এইসব মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার জন্য যেকোনোভাবে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।
আপনার মতামত লিখুন :