ডেস্ক রিপোর্ট : কালো টাকার পরিমাণ এবং কালো টাকা সাদাকরণ প্রসঙ্গে বলার জন্যেই কাগজ কলম হাতে নিয়েছিলাম। আমার ছোট মেয়েটির প্রশ্ন, কালো টাকা আবার কী জিনিস? আমরা ৫০০, ১০০, ৫০, ১০ কোন নোটের রং তো কালো দেখিনি? আর কালো জিনিস আবার সাদা হয় কীভাবে? আমরা তো বরং সাদা চুলে কালো রং লাগাতে দেখি, শুনেছি কালো কাপড়গুলোও নাকি প্রথমে সাদা থাকে, কিন্তু কালোকে সাদা করতে তো শুনিনি। লেখাটি অল্প সময়ে শেষ করতে হবে তাই মেয়ের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলাম।
আমাদের দেশে কালো টাকার পরিমাণ কত তার সঠিক হিসাব হয়ত কারো কাছেই নেই। বিভিন্ন আলামতের মাধ্যমে একেকজন একেক রকম সংখ্যা বলে থাকেন। কয়েক বছর আগে বিদেশী একটি সংস্থার রিপোর্টে কালো টাকার পরিমাণ বলা হয়েছিল জিডিপির ৩৭%, বা ১ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এ সমীক্ষাটি চালিয়েছিলেন অষ্ট্রিয়ার এক গবেষক। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কালো টাকা আছে জিডিপির ৪৬% থেকে ৮১% এর মধ্যে, যা হিসাব করলে হয় ১ লাখ ৭৭ হাজার কোটি থেকে ৩ লাখ ১০ হাজার কোটির মধ্যে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, বাস্তবে কালো টাকার পরিমাণ হবে আরো অনেক বেশি। যেখানে শুধু একবার ভুল জায়গায় চালক কতৃক গাড়ী প্রবেশ করিয়ে দেয়াতেই বেরিয়ে আসে ৭০ লাখ টাকা, বড় বড় সাহেবদের নিকট পাওয়া যায় তুলার পরিবর্তে টাকাভর্তি বালিশ, সুবিধাজনক জায়গায় বদলী হওয়ার জন্য নাকি নজরানা দিতে হয় লক্ষ-কোটি টাকা, সামান্য মেম্বর-চেয়ারম্যান নির্বাচনের জন্য ব্যয় করা হয় কোটি টাকা (এমপিদের কথা নাই বা বললাম)। সে টাকাগুলো সুদে-আসলে উঠালে তার পরিমাণ কত হবে? আবার বড় বড় রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার অর্ধেকও প্রকল্পে ব্যয় হয় না বলে জনমুখে শোনা যায় সব সময়, সেখানে কালো টাকার পরিমাণ ৩ লাখ কোটি বললে কম বলা হবে নিশ্চয়। তবে বর্তমান পরিভাষায় শুধু অবৈধ বা হারাম পন্থায় কামাই করা টাকাকেই কালো টাকা বলা হয় না; বরং কর পরিশোধ না করে গোপন রাখা হয়েছে এমন বৈধ উপার্জনের টাকাও কালো টাকার অন্তর্ভুক্ত। অনেকে আবার এ শ্রেণীর কালো টাকার নাম ‘অপ্রদর্শিত আয়’ও দিয়ে থাকেন।
আজকে আমি শুধু প্রথম প্রকারের কালো টাকা নিয়েই বলতে চাই, যার পরিমাণ ২য় শ্রেণীর কালো টাকার চেয়ে নিশ্চয় অনেক গুণ বেশি এবং যে কালো টাকার মালিকদের কাছে শুধু সাধারণ জনগণই নয়; বরং সম্ভবত পুরো রাষ্টযন্ত্রই জিম্মি হয়ে আছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে কালো টাকার উপার্জন এক শ্রেণীর লোকের কাছে অত্যন্ত সহজ-সরল একটি কাজ এবং এটি হয়ে থাকে অনেকটা প্রকাশ্যেই। কালো টাকার বড় বড় হোতারা অনেক সময় নেপথ্যেই থেকে যায় এবং অবশ্যই তারা নিজেদেরকে রাখে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
এ কালো টাকাগুলোই মূলত সৃষ্টি করে সামাজিক বৈষম্য। বনী আদমের বৃহত্তর অংশ একটি গোষ্ঠির শোষণের হাতিয়ার হয়ে থাকার পিছনে কালো টাকার প্রভাব অসামান্য। আর পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধিতে, প্রয়োজনীয় আবাসন সুবিধা (জমি/ফ্ল্যাট) সাধারণ জন-গোষ্ঠির আয়ত্বের বাইরে চলে যাওয়ার পিছনে এ শ্রেণীর টাকাওয়ালাদের প্রভাব তো কারো অজানা নয়। জমি/ফ্ল্যাটের মূল্য যতই হোক ঐ শ্রেণীর লোকদের জন্য তা কোনো সমস্যাই নয়। আর গাড়ির ট্যাক্স বা মূল্য যতই বৃদ্ধি পাক তাদের পরিবারের সকলের জন্য ১/২ টি করে কোটি কোটি টাকার গাড়িও থাকা অপরিহার্য। সড়ক-মহাসড়কে জায়গা থাকুক বা না থাকুক ঐসব গাড়ির লাইসেন্স দিতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।
আর এ কালো টাকাগুলো একসময় সাদা হওয়ার পর এগুলোর মালিকগণ হয়ে যায় ব্যাংক, বীমা, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, টিভি, পত্রিকা ও গ্রুপ অব কোম্পানিজের মালিক। (সব ব্যবসায়ী বা মিডিয়ার মালিক যে এ শ্রেণীর নয় তা তো বলাই বাহুল্য।) সুতরাং কালো টাকা সাদা করতে হবে বৈকি। এদেরকে ধুয়ে-মুছে জাতীয় অর্থনীতিতে, শেয়ারবাজারে এবং নতুন ব্যাংক, টিভি স্থাপনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে অবদান রাখার সুযোগ না দিলে তা তো জুলুমের আওতায় পড়ারই কথা। এ কারণেই কালো টাকা সাদা করা নিয়ে কারো কারো আপত্তি বাঁকা চোখে দেখেন ঐ বিজ্ঞ রাজনৈতিক ও সুধী (!) মহল।
বড়দের সে বিতর্কে আমাদের প্রবেশ করা উচিত হবে না। আমরা শুধু এতটুকু বলতে পারি যে, ইসলামে কালো টাকা উপার্জনের যেমন বৈধতা নেই, তেমনি সে টাকা সাদা করার ন্যূনতম সুযোগও নেই। এ ধরনের অবৈধ উপার্জনকারী কালো টাকাওয়ালা ধরা পড়লে শুধু তার জেল-জরিমানাই হবে না; বরং ক্ষেত্রবিশেষে তার হাতও কাটা যাবে। আর সকল টাকা বাজেয়াপ্ত করে যথাসম্ভব মালিকদেরকে ফিরিয়ে দিতে হবে। মালিক সনাক্ত করা সম্ভব না হলে তা জমা হয়ে যাবে রাষ্টীয় কোষাগারের দরিদ্রফান্ডে, যা শুধুই ব্যয় করা যাবে গরীব-দুঃখীদের পিছনে।
এমন বিধান ও তার প্রয়োগ থাকলে কেউ কি আর কালো টাকা উপার্জনের পিছনে মেতে থাকবে? কিন্তু প্রশ্ন হল কবে ফিরে আসবে সে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। আমরা আমাদের আমল-আখলাক, লেনদেনকে শুদ্ধ করব আর কবে!! এবং ক্ষমতাসীনরা প্রচলিত দূষিত অর্থব্যবস্থা থেকে বের হয়ে ইনসাফপূর্ণ হালাল অর্থব্যবস্থা কায়েম করতে বাধ্য হবে আর কবে?
সূত্র: মাসিক আল কাউসার