ডেস্ক রিপোর্ট: পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে গতকাল যৌথভাবে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত চার হেভিওয়েট কূটনীতিক। তারা হলেন- মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার, বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিঙ্ক এবং জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো। সূত্র জানিয়েছে- বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের অবস্থা সরজমিনে দেখতে গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক ও কানাডা মিশনের প্রতিনিধিসহ ওই চার জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকের সমন্বিত একটি প্রতিনিধি দল কক্সবাজারস্থ রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। মূলত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেই তারা সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক চান। সেগুনবাগিচাস্থ সচিবের দপ্তর সংলগ্ন সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ডেস্কের প্রধানরাও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে ক্যাম্প পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করা ছাড়াও রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ, ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরেন। সরকারের তরফে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং ভাষানচরে অস্থায়ী পুনর্বাসন প্রশ্নে ঢাকার অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়। সরকারি প্রতিনিধি এবং কূটনীতিকরা পরস্পরের বক্তব্য মনোযোগের সঙ্গে নোটে নেন।
হৃদ্যতাপূর্ণ ওই বৈঠকে প্রত্যাবাসন বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়। তাতে মোটাদাগে ঢাকার অবস্থানের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন কূটনীতিকরা। তবে ভিন্ন মত আসে ভাষানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর প্রশ্নে। এ নিয়ে কূটনীতিকরা তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। ঢাকার তরফে তা খণ্ডনের চেষ্টা করা হয়। এ-ও বলা হয়, কূটনীতিকরা চাইলে সরকারি উদ্যোগে ভাষানচর পরিদর্শন করতে পারেন। সেখানে সরকার যা করেছে তা স্বচক্ষে দেখতে পারেন। উল্লেখ্য, গত ২২-২৪শে সেপ্টেম্বর হাই প্রোফাইল ওই কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল নিজস্ব উদ্যোগে কক্সবাজার সফর করে। সফর শেষে জাতিসংঘ অফিস পরিদর্শনকারী কূটনীতিকদের সমন্বিত বক্তব্য সংবলিত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশেষত স্থানীয় জনগোষ্ঠী যে উদারতার নিদর্শন রেখেছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন বিদেশি জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকরা।
তারা বলেন- নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে বাংলাদেশের যে প্রচেষ্টা বিশ্বসম্প্রদায় তার প্রতি জোর সংহতি প্রকাশ করছে। তাদের মতে, রোহিঙ্গা সংকটের মূলে যেতে হবে। বিদ্যমান সমস্যাগুলো এখনই সমাধান করতে হবে। আর এর সমাধান মিয়ানমারের কাছেই রয়েছে। সেগুনবাগিচার বৈঠকেও কূটনীতিকরা তাদের সেই বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করেন।
বলেন, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস হামলাকারী দুর্বৃত্তদের বিচার নিশ্চিত হলেই রোহিঙ্গারা নিজেদের দেশে ফিরে যেতে ভরসা পাবে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি কীভাবে রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলছে এবং তারা তাদের ভবিষ্যৎকে কীভাবে দেখছে- এ নিয়ে বাস্তুচ্যুতরা কূটনৈতিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলাপে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন বলেও জানানো হয়।
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে আছে জানিয়ে পরিদর্শনকালে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার বলেন, ২০১৭ সাল থেকে কক্সবাজার জেলায় নির্দিষ্ট খাতে মানবিক সহায়তার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তায় তার দেশ প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে। একই সঙ্গে এই সংকট সমাধানে এবং শরণার্থীদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে কাজ করছে।
মিলার স্পষ্ট করে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি কোভিড-১৯ মহামারিকালেও।
মার্কিন দূত বলেন, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক তহবিলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের যোগান দেয় কক্সবাজার সফরকারী প্রতিনিধি দলের সদস্যদেশ এবং সংস্থা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল শ্বাসতন্ত্রের তীব্র সংক্রমণজনিত আইসোলেশন ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখেন। ১৪টি চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রায় ১০০০ শয্যা রয়েছে, যা বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা- উভয় জনগোষ্ঠীর করোনা রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে প্রস্তুত রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে কোভিড-১৯ পরীক্ষা কেন্দ্রও। প্রতিনিধিদলের কেউ কেউ অস্থায়ী শিক্ষাকেন্দ্র পরিদর্শন করেন, যেগুলো কোভিড-১৯-এর কারণে সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। একটি প্রতিবেদনে এসেছে, শরণার্থীদের মধ্যে হতাশা, শিশুদের প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রমের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিনিধিদল আরো বেশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে শিক্ষা কেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে পুনরায় চালু করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের সরকারি উদ্যোগগুলো পর্যবেক্ষণ করেন এবং এ নিয়ে তাদের পর্যালোচনা তুলে ধরেন। ঢাকার বৈঠকেও তারা এসব সুপারিশ তুলে ধরেন বলে জানা গেছে।
স্মরণ করা যায়, কক্সবাজার পরিদর্শনকালে কূটনৈতিক প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ভাষানচর প্রকল্প বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিঙ্ক বলেন, সামপ্রতিক সময়ে ভাষানচরে ‘গো অ্যান্ড সি’ একটি ভালো উদ্যোগ ছিল। তার মতে, জাতিসংঘ প্রস্তাবিত প্রযুক্তিগত এবং সুরক্ষা বিষয়ক মূল্যায়নের বাস্তবায়ন জরুরি। ইতিমধ্যে সেখানে স্থানান্তরিত ৩০৬ জন শরণার্থীর পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য একটি পৃথক মানবিক ও সুরক্ষা বিষয়ক মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করেন যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাড়াদান এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীকে সমর্থনের ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার অব্যাহত থাকবে।
সেখানে বৃটিশ হাইকমিশনার বলেন, রোহিঙ্গা শিবির ও শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার তথা সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে কয়েক মাসের প্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞার পর রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন এবং বাংলাদেশের প্রতি একাত্মতা পুনর্ব্যক্ত করতে অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে আমরা কক্সবাজার পরিদর্শন করেছি। সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ প্রশমিত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় একটি কার্যকর এবং জীবন রক্ষাকারী সাড়াদান প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।মানবজমিন