মোশায়ারা আক্তার জলি: [২] আজ বৃহস্পতিবার (১অক্টোবর) দেশবরেণ্য বর্ষীয়াণ রাজনীতিক ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ৭৫ তম জন্মদিন।এই কিংবদন্তী নেতা ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার গয়েশপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
[৩] তিনি বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের বীর সংগঠক, সাবেক মন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, প্রথিতযশা ভূ-বিজ্ঞানী, লেখক, কলামিষ্ট এবং গবেষক।
[৪] ড.মোশাররফ কুমিল্লার দাউদকান্দি হাইস্কুল থেকে '৬২ সালে মেট্রিকুলেশন, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে '৬৪ সালে আই.এসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে '৬৮ সালে এম.এসসি, '৭০ সালে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে এম.এসসি, '৭৩ সালে ডিআইসি ডিপ্লোমা এবং '৭৪ সালে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন। '৭৫ সালে বিলেত থেকে দেশে ফিরে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন এবং পর্যায়ক্রমে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। '৮৭ থেকে '৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূ-তত্ত্ব বিভাগে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। '৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবার জন্য তিনি ঢাবি'র শিক্ষকতা থেকে পদত্যাগ করেন।
[৫] বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ও কর্মজীবনে নন্দিত নেতা ড.মোশাররফের অর্জনের ভাণ্ডার বিশাল। দেশ ও জনগণের কল্যাণে তাঁর রয়েছে অসামান্য অবদান।
তিনি উন্নয়ন ভাবনার একজন আলোকিত রাজনীতিক। ছাত্রজীবনেই তাঁর মেধা,দক্ষতা, মানবিক গুণাবলী ও নেতৃত্বের অসম যোগ্যতা আলোর দ্যুতির ন্যায় দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ড.মোশাররফ ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের এজিএস এবং ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষে হাজী মুহাম্মদ মহসিন হলের ভিপি নির্বাচিত হন।
[৬] মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির জন্য তিনি '৭১সালে বিলাত প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংগঠিত করেন এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক হিসাবে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। বিদেশে দুঃসাহসী ও সংগ্রামী ভূমিকার কারণে তিনি স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের জনগণ ও অস্থায়ী সরকারের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন।
[৭] বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নিমন্ত্রণে ড.মোশাররফ বিলেত থেকে বাংলাদেশে আসেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর প্যাডে নিজহাতে লিখিত অভিনন্দন জানিয়ে 'মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিলেতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ' ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে অভিনন্দন পত্র দেন (তারিখ-২০ ফাল্গুন,১৩৭৮ বঙ্গাব্দ)।
[৮] জাতীয় স্বার্থরক্ষার প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি নায়কোচিত ভূমিকা রেখেছেন । এতে বিভিন্ন সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক রাজনৈতিক মামলায় ড.মোশাররফ ১৯৮৬, ১৯৯৬, ২০০৭,২০১২ এবং ২০১৪ সালে গ্রেফতার হয়ে প্রায় ৫ বছর কারান্তরীণ ছিলেন।
[৯] '৭৯ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আহবানে সাড়া দিয়ে ঢাবি'র এই মেধাবী শিক্ষক বিএনপি'র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন এবং দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ড.মোশাররফকে বিএনপি'র প্রতিষ্ঠাকালীন প্রথম নির্বাহী কমিটির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক পদে দায়িত্ব দেয়া হয়। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে 'ছাত্রদল' বাংলাদেশের অন্যতম বিশাল ছাত্র সংগঠনে রূপ নেয়। তিনি '৮৬ থেকে '৯৪ সাল পর্যন্ত দলের যুগ্ম-মহাসচিব পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি '৯৪ সাল থেকে বিএনপি'র সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন।
[১০] ড.মোশাররফ কুমিল্লা-২ (দাউদকান্দি ও মেঘনার অংশ) আসন থেকে ৪ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি '৯১-'৯৬ মেয়াদে বিএনপি সরকারের বিদ্যুৎ,জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রী, '৯৬ সালে স্বল্প মেয়াদে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ২০০১-০৬ মেয়াদে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী হিসাবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন।
[১১] ড.মোশাররফ স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে দাউদকান্দির উত্তরাঞ্চলে 'তিতাস' নামে একটি নতুন উপজেলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অবহেলিত জনপদকে আলোকিত করেছেন। উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা- ড.মোশাররফ দাউদকান্দিকে পৌরসভায় উন্নীত ও বিশাল পৌরভবন নির্মাণ, এলাকায় ২টি কলেজ,২টি হাইস্কুল,১টি গার্লস হাইস্কুল,১টি দাখিল মাদ্রাসা ও এতিমখানা ,শহীদনগরে ট্রমা সেন্টার,দাউদকান্দি সদরে ২০ শয্যার হাসপাতাল, তিতাস ও মেঘনায় উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন, ২ টি ৫০ শয্যার হাসপাতাল ও ২টি থানা কমপ্লেক্স ভবন, ঢাকারগাঁওয়ে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ফায়ার সার্ভিস ষ্টেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দাউদকান্দি উপজেলার শ্রীরায়ের চর-ছেঙ্গারচর সড়কে গুণবতী শাখা নদীর উপর ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩১মিটার ব্রিজ নির্মাণ, রাজধানীর সাথে সহজ যোগাযোগের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভাটেরচর- মেঘনা উপজেলার সংযোগে নতুন সড়ক ও সেতু নির্মাণ করেন। ড.মোশাররফ দাউদকান্দি,মেঘনা ও তিতাস উপজেলায় অভ্যন্তরীণ নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ ও পাঁকাকরণ, অসংখ্য ছোট বড় ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ, মসজিদ, সমাজসেবী ক্লাব, হাটবাজার, কবরস্থানের উন্নয়ন,নদী বিধৌত মেঘনা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাকে বিদ্যুতায়নসহ প্রায় ৪০০ কি.মি. নতুন বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ করেছেন। এইসব উপজেলায় স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় নতুন নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ এবং খেলার মাঠ ভরাট কাজ বাস্তবায়ন করেন। সর্বোপরি এই সময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য,কৃষি, যোগাযোগ, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও গ্রামীণ অবকাঠামো খাতে এলাকায় প্রায় এক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান আধুনিক করেছেন। অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়েছেন।
[১২] ড.মোশাররফ এলাকার ৩ সহস্রাধিক শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীকে চাকরী দিয়েছেন। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি দাউদকান্দি সেতু নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান- ড.মোশাররফ ফাউণ্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে দাউদকান্দি পৌর সদরে ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন কলেজ,ইলিয়টগঞ্জে ড.মোশাররফ ফাউন্ডেশন কলেজ,তিতাসের গোপালপুরে ড.মোশাররফ হোসেন হাইস্কুল, দাউদকান্দির নৈয়াইরে ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন হাইস্কুল, গৌরীপুরে বিলকিস মোশাররফ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং সোনাকান্দায় ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন রহমানিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেছে। এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অাধুনিক পাঠদান পদ্ধতি ও ঈর্ষণীয় ফলাফলের মাধ্যমে এলাকার শিক্ষাব্যবস্থাকে করেছে আলোকিত ও সমৃদ্ধ।
[১৩] ড.মোশাররফ 'প্লাবণ ভূমিতে মৎস্য চাষ পদ্ধতি'র উদ্ভাবক। এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশে মৎস্য খাতের উন্নয়নে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। 'প্লাবণ ভূমিতে মৎস্য চাষ পদ্ধতি- দাউদকান্দি মডেল' হিসাবে সরকারী স্বীকৃতি পেয়েছে। মৎস্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার স্বর্ণপদক লাভ করেন।
২০০৩ সালে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬ তম সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর সভাপতিত্বে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) গৃহীত হয়। বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন এবং বিশ্বব্যাপী তামাক বিরোধী আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ড.মোশাররফকে 'World no tobacco award-2004' পদকে ভূষিত করেন।
[১৪] ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেনের লেখা 'মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান', 'প্লাবণ ভূমিতে মৎস্য চাষ: দাউদকান্দি মডেল', 'সংসদে কথা বলা যায়', 'এই সময়ের কিছু কথা',' 'ফখরুদ্দিন- মইন উদ্দিনের কারাগারে ৬১৬ দিন', 'রাজনীতির হালচাল', 'সময়ের ভাবনা', 'জরুরী আইনের সরকারের দুই বছর (২০০৭ ও ২০০৮)' 'মূল্যবোধ অবক্ষয়ের খণ্ডচিত্র'এবং 'প্রগতি ও সত্যের সন্ধানে' নামের ১০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আরো ৩টি গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি দেশ ও জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখেন। এ ছাড়াও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সাময়িকিতে তাঁর ৫০টির বেশী বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ভূ-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণা ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ড.মোশাররফের জীবনবৃত্তান্ত 'Who is in the World' কেমব্রীজ বায়োগ্রাফি জার্নাল এবং আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইন্সটিটিউট প্রকাশিত পুস্তকে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। ভূ-তত্ত্ব বিষয়ে স্ট্রাকচারাল এ্যানালাইসিসে তাঁর নতুন উদ্ভাবন 'Hossains method of extension' আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি নোবেল পুরুস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর আব্দুস সালাম প্রতিষ্ঠিত আইসিটিটি'র এসোসিয়েট সদস্য এবং Third World academy of science এর একজন ফেলো। তিনি ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক।
[১৫] ৭৫তম জন্মদিনে ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন কুমিল্লার দাউদকান্দি, মেঘনা, তিতাস ও হোমনা উপজেলাবাসী, দেশ ও বিদেশের বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মী, শুভার্থীসহ দেশবাসীকে সালাম ও শুভাশীষ জানিয়েছেন। তিনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সতর্কতার সাথে জীবন পরিচালিত করার পরামর্শ দেন। ড.মোশাররফ বলেন, আল্লাহ-তায়ালা আমাকে সুস্থ রেখে সুখে-দুঃখে যাতে আপনাদের পাশে থাকতে পারি,সে জন্য দোয়া করবেন। আমি সকলের নিরাপদ ও সুখময় জীবন কামনা করছি।মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোক, আমিন। সম্পাদনা: হ্যাপি