দীপক চৌধুরী: আওয়ামী লীগ টানা এগারো বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার সুবাদেই যেনো এখন জেলা-উপজেলায় দলের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ব্যক্তিরা রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। তাদের সঙ্গে গণমানুষের যোগাযোগ নেই। এখন দল ক্ষমতায়। এর আগে দলটি ক্ষমতায় আনতে কতো রকম কঠিন লড়াই করতে হয়েছে তা অনেকের কল্পনায়ও নেই। একটা সময় সরকারে প্রশাসন-পুলিশসহ সর্বত্র জামায়াত-বিএনপিপন্থী লোক ছিল। তাদের একমাত্র কাজ ছিল আওয়ামী লীগ ঠেকাও। আওয়ামী লীগের আন্দোলন ঠেকাতে তৎপর ছিল বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের প্রশাসনে থাকা লোকেরা, পুলিশে থাকা তাদের লোকেরা। কারণ, তখন পুলিশ-প্রশাসনে থাকা লোকদের অনেকে চাকরি রক্ষা করতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির সরকারের মন্ত্রী নেতাদের নির্দেশ মানতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা জানি, সরকারি হলেও বেসিক ব্যাংক ছিল দেশের ভালো ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ছিল। কিন্তু ২০০৯ থেকে ১৪ সাল পর্যন্ত শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু চেয়ারম্যান থাকাকালে ব্যাংকটিকে প্রায় ধ্বংসের কিনারে চলে যায়। এরপর ভালো করার জন্য আরেকজনকে ছয় বছরের জন্য চেয়ারম্যান করা হয় কিন্তু অগ্রগতি হয়নি। শোনা যায়, ব্যাংকিং খাত এলোমেলো হয়ে গেছে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই এই খাত ঠিক করা দরকার। কারণ, আমাদের ব্যাংকিং খাত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এখানে গন্ডগোল হলে সঠিকভাবে কাজ করে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লড়াইদীর্ঘ দিন থেকে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেই এর বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন কঠোর। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংসদের প্রতিটি অধিবেশনে, প্রতিটি অনুষ্ঠানে, আলোচনা, সিম্পোজিয়ামে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকন্যার অবস্থান ছিল সুদৃঢ়, এখনো এই নীতি আছে।
৯ জুলাই (২০২০) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ সংসদের অষ্টম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া অব্যাহত থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘কে কোন দলের সেটি (আমাদের কাছে) বড় কথা নয়।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে গিয়ে সরকারকে উল্টো দুর্নীতির দোষ দেয়া হচ্ছে। ‘আমরা (দুর্নীতিবাজদের) ধরছি। আর চোর ধরে যেন আমরাই চোর হয়ে যাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রীর এই কথা মিডিয়ায় আসার পরের দিনই স্বাস্থ্য খাতে বিগত ১০ বছরের দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। গ্রেফতার করা হয়েছে কোভিড-১৯ নিয়ে প্রতারণা ও দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে। বিশেষত করোনা পরীক্ষায় ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণাসহ বিভিন্ন দুর্নীতির হোতা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম এবং একইভাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার টেস্ট না করেই রিপোর্ট ডেলিভারি দেওয়া জেকেজি হেলথ কেয়ারের প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরী ও অন্যতম সহযোগী তার স্ত্রী জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু ইদানিং দেখা যাচ্ছে দুর্নীতির ভয়াবহতার হোতা সাহেদের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতি মামলা পাশে ফেলে রেখে অস্ত্র মামলা নিয়ে দারুণ হৈচৈ হচ্ছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি সরকার গঠন করেন ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। প্রথম ভাষণ থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কথা প্রবলভাবে উল্লেখ করেছেন। গত বছর সেপ্টেম্বর জুড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান, ক্যাসিনো কিংবা জুয়ার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোরতা এবং যুবলীগে শুদ্ধি অভিযান সরকারের প্রশংসনীয় কাজ হিসেবে গণ্য হয়েছে। তখন ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের উপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষুব্ধ হওয়ার মূল কারণও ছিল দুর্নীতিসহ নানান অনিয়মের সঙ্গে ওই নেতারা জড়িত হয়ে পড়েছিল। এজন্য তাদের পদত্যাগও করতে হয়। গত বছর ১৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানেও একই কথা পুনঃউচ্চারণ করেন যে, যিনি ঘুষ খাবে সে-ই কেবল অপরাধী নয়, যিনি দেবে সে-ও সমান অপরাধী।’ এ বিষয়টা মাথায় রেখে পদক্ষেপ নিলে এবং এ বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ হলে অনেক কাজ আমরা দ্রুত করতে পারব।’ চতুর্থ মেয়াদে জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হলে ২০১৯-এর ১২ জুন সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে শেখ হাসিনা দুর্নীতির প্রতি তার সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ঘোষিত ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক নির্বাচনি ইশতেহারের ২১টি বিশেষ অঙ্গীকারের মধ্যে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু রাজনীতির জটিল অংকে দুর্নীতিবাজদের অপতৎপরতা কমছে কোথায়? একদা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের যারা রাজপথে প্রাণ দিয়েছে, রাজপথে যারা লাঞ্ছিত হয়েছে, গুলিবিদ্ধ হয়েছে, প্রাণ দিয়েছে তাদের খোঁজ আমরা রাখতে চাচ্ছি না এখন। বরং সর্বত্র বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছি আমরা। কোনো জায়গায় প্রশাসন অসহায়। আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলে জেলা-উপজেলায় যারা প্রাণ হারিয়েছে ‘তারা ত্যাগী’ বলে এ সরকার আমলে সুযোগ নিচ্ছে একটি শ্রেণি। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুনোখুনি কওে নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘ত্যাগী’ নেতার ‘তকমা’ লাগানো হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, পূর্ণাঙ্গ কমিটি তৈরি করার কথা কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একশ্রেণির নেতার বাণিজ্য শুরু। শত শত উদাহরণ দেওয়া যাবে। লুপা তালুকদারসহ একটি সুবিধাবাদী শ্রেণির মিথ্যাচার তো আছেই। দুর্নীতিবাজ রাজনীতির আর দুষ্ট চক্রের সদস্যরা আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলতে লুপাদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ওই শ্রেণির নেতা অর্থের বিনিময়ে পদ বিক্রয় করেছে। সুবিধাবাদীরা পদে ঢুকেছে এবং বসেই পদের অপব্যবহার করছে। রাজধানীর মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এই চিত্র পাওয়া যায়। কিছু কিছু জেলা-উপজেলায় এই চিত্র ভয়ঙ্কর পর্যায়ের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে কৌশলে অনুপ্রবেশ করেছে অপ্যত্যাশিত ব্যক্তি, এমনকি কোথাও কোথাও একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধিতাকারীরাও। ঢুকেই পর্যায়ক্রমে তারা দলের স্থানীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের দরপত্রসহ যাবতীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। রাতারাতি মালিক বনেছে বিপুল অর্থসম্পদের। অশিক্ষিত মূর্খ অযোগ্য একশ্রেণির ব্যক্তি দলে দীর্ঘদিন ধরেই আছে। তারা তরুণ-প্রতিবাদী শিক্ষিত ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানদের ঠেকাতে ব্যস্ত। স্থানীয় প্রশাসনের কেউ কেউ বলতে গেলে এখন তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বারবারই দলে অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু সেই নির্দেশনা কঠোরভাবে কী পালিত হচ্ছে? আমরা জানি- জবাবদিহি ও সুশাসন তথা গণতন্ত্র অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু রাজনীতি যদি দুষ্টচক্রের হাতে মিশে যায় পরিণতি ভয়াবহ হবেই। দুর্নীতি একটি আমলাতান্ত্রিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক সমস্যা। এর সমাধানসূত্র জবাবদিহির মধ্যে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ ও পুষ্টিহীনতা বইয়েও গণতন্ত্রের অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন। গণতন্ত্রে বিরোধী দল কর্তৃক সমালোচনা এর অপরিহার্য অংশ। তাঁর ‘ডেভেলপমেন্ট এজ ফ্রিডম’ বইয়েও তিনি একই অভিমত প্রকাশ করেছেন এবং উন্নয়নের জন্য উন্মুক্ত গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের উপস্থিতি যে জরুরি এ কথা তিনি জোর দিয়ে বলেছেন। কিন্তু সম্ভবত এটা এদেশের জন্য শতভাগ প্রযোজ্য নয়। কারণ, দুর্নীতির অভিযোগে আদালত থেকে সাজা পাওয়া দলপ্রধানের মুক্তির জন্য আন্দোলনের হুমকি দেওয়া হয়। রাজনীতির নামে লুটপাট, মানুষ হত্যা, পেট্রল ঢেলে নিরপরাধ ব্যক্তি হত্যা, বিনাকারণে শ্রমিক-দিনমজুরকে হত্যা, কর্তব্যরত পুলিশ-র্যাবকে অন্যায়ভাবে এদেশে হত্যা করা হয়ে থাকে। বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলের ভূরি ভূরি উদাহরণ সামনে রয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যার পর হত্যার বিচার বন্ধ করতে আইন পাস করা হয় সংসদে। গ্রেনেড মেরে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতাকে হত্যার চেষ্টা চালোনো হয়। কয়েক দিন আগেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যত অপকর্ম এই অনুপ্রবেশকারীরাই ঘটাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার লোকের অভাব নেই। তাদের অযোগ্যতা ও অশিক্ষার কারণে অনুপ্রবেশকারীদের প্রবেশের সুযোগ ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীরা জেলা আওয়ামী লীগে স্থান পায় কীভাবে? দলের একাধিক নেতা জানান, অর্থের সংযোগ রয়েছে সেখানে। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে একটি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার শপথ নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি নিজস্ব উদ্যোগেই ‘শুদ্ধাচার’ ও এর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি অ্যানুয়াল পারফমেন্স এগ্রিমেন্ট (এপিএ)-২০২০ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিওকনফারেন্সের মাধ্যমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়েছিলেন। এদেশের মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যার ওপর। তবে পোড় খাওয়া প্রবীণ রাজনীতিকদের অনেকে মনে করেন, দেশে একটি ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে আগে রাজনৈতিক দুর্র্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে হবে। তৃণমূলে রাজনীতির দোহাই দিয়ে নিজেরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন অনেকে। এসব দেখে উপজেলা বা তৃণমূল প্রশাসনের লোকেরা দর্শকের মতন আছেন। থানার ওসিকে ভয় দেখানো হয় রাজনীতির, এসি ল্যান্ড, ইউএনওকে ভয় দেখানো হয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির। অবশ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন ‘আপনাদেরকেই এই শুদ্ধাচারের পরিকল্পনা করতে হবে এবং কিভাবে তা বাস্তায়ন করা যায় সেই উপায় বের করতে হবে। এই পরিকল্পনা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছাতে ও তা সফলভাবে কার্যকর করতে হবে। আর যারাই এটা করতে পারবে, তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে।’ আমরা জানি, রাজনীতির কঠিন ময়দানে জাতির জনকের এই কন্যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময়ের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কারণেই আজ টেকসই উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ। মোট চারবারের প্রধানমন্ত্রী তিনি। টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সাড়ে এগারো বছর ধরে দুঃসাহসী নেতৃত্ব দিয়ে দেশের জনগণকে যেমন আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছেন ঠিক তেমনি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এক বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন।
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক