ড. এম এ মান্নান: ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, সাপ্তাহিক বন্ধের শেষ দিন। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমের শনিবার দিনটি ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল। সময় বিকেল ৫টা ২৫ মিনিট, দোর্দন্ড মার্তণ্ডের খরতাপ অনেকটা কমে এসেছে। দলীয় প্রতিবাদ র্যালি এবং সভা চলছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের রাস্তায়। উš§ুক্ত ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর বিশ মিনিটের বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ গগণবিদারী আওয়াজে চারদিকে হুলুস্থুল, দৌড়াদৌড়ি, আর্তনাদ, গোঙানি, বাঁচানোর আকুতি। সুন্দর রোদেলা বিকেল মুহূর্তের মধ্যে হয়ে গেলো ধোঁয়াচ্ছন্ন। বোমায় বিধ্বস্ত সড়কটি হয়ে উঠলো নিহত-আহত মানুষের লাল লাল ছোপছোপ রক্তের কারবালা।
আচমকা গ্রেনেড আক্রমণে হতবিহ্বল মানুষজনের ছুটাছুটি আর পদদলন পরিস্থিতিকে করে তুললো আরও ভয়াবহ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কানের আঘাত নিয়ে বেঁচে গেলেন ভাগ্যক্রমে অনুসারীদের বেষ্টনীর মধ্যে থাকার কারণে কিন্তু দুই পা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেত্রী দলের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইভী রহমান (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী)। আহত অবস্থায় তিন দিন পর ইহলোক ত্যাগ করেন আজীবন নারী জাগরণ আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা এই মহীয়সী নেত্রী। একুশের ‘ঢাকা এ্যাটাক’ ছিল সে বছরে প্রথম থেকেই সারা দেশে ‘বোমা বিস্ফোরণ’ সিরিজের সর্বশেষ ঘটনা, এ ঘটনার কয়েক দিন আগেই ৭ আগস্ট সিলেটে এক বোমা আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের এক জন স্থানীয় নেতা। তারই প্রতিবাদে সন্ত্রাসবিরোধী র্যালী অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো ২১ আগস্ট। সেদিনকার গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত এবং তিন শতাধিক আহত হয়েছিলেন। আহতদের কেউ পা হারিয়ে, কেউ হাত হারিয়ে বা শরীরে গ্রেনেডের স্পিøন্টার নিয়ে এখনও জীবš§ৃত অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। অনেকে চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে গিয়েছেন।
বিবিসির এক তথ্যসূত্রে জানা যায়, এর পূর্বে বিগত পাঁচ বছরে শতাধিক লোক বোমা হামলায় নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের জেলা সিলেট থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পশ্চিমের খুলনা পর্যন্ত ব্যাপৃত এলাকায় বিভিন্ন স্থানে সিনেমা হল, পত্রিকার সম্পাদক, রাজনৈতিক র্যালি, এমনকি বাংলাদেশে বৃটিশ হাইকমিশনারের উপরও বোমা হামলা হয়েছে। অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল প্রতাপশালী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে হামলা-মামলায় জড়িয়ে হতভম্ব করে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া। একুশের হামলাটি বিগত হামলাগুলোরই ধারাবাহিকতায় ঘটানো হয়। এ ঘটনার পরেও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা বাংলাদেশে ৬৪ জেলার ৬৩টি শহরে সিরিজ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। তৎকালীন সরকার কোনোটিরই সুবিচার করেননি, শুধু বিচারের নামে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়েছিলেন।
গণতন্ত্রের ইতিহাসে পরপর ১৩টি গ্রেনেড ছুঁড়ে নিরীহ মানুষের উপর এ রকম বর্বর আক্রমণ নজিরবিহীন। আশপাশের ভবনগুলোর ছাদ থেকে এলোপাথাড়ি ছুঁড়ে মারা গ্রেনেডের আক্রমণ ছিল স্পষ্টত একটি হত্যাপ্রচেষ্টা এবং কার্যত পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। মূল টার্গেট ছিল বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধানকে এভাবে জনসভায় হঠাৎ আক্রমণ করে হত্যা করার প্রচেষ্টা একমাত্র ওদের পক্ষেই সম্ভব যারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করে না এবং খুন-রাহাজানি যাদের ক্ষমতা দখলের একমাত্র অস্ত্র। এ ঘটনার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মুখে শুধু dastardly attack বলেই দায়িত্ব শেষ করেছেন (বিবিসি নিউজ, ২২ আগস্ট, ২০০৪); অপরাধী গ্রেপ্তার বা কোনো প্রকার তদন্ত এবং বিচারের ব্যপারে ছিলেন একেবারেই নিরব। তিনি এবং তার দলটি আজ পর্যন্তও নির্বিকার। মতিঝিলের একজন পকেটমারকে এ্যারেস্ট করে তাকে দিয়ে সাজানো ‘জজ মিয়া’ নাটকটিও শেষ পর্যন্ত গুবলেট হয়ে গিয়েছে। বিচারপতি জয়নাল আবেদিনকে দিয়ে এক ব্যক্তিবিশিষ্ট জুডিসিয়াল কমিশন করে তদন্তের নামে মকারি করা হয়েছে। এ বিচরপতি দেশবাসীকে জানাতে চেয়েছেন যে, বোমা হামলাটি ছিল দেশি-বিদেশি শত্রুদের দ্বারা পরিচালিত একটি ঘটনা। তাকে পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনের বিচারক নিয়োগ দিয়ে পরিকল্পিত মকারির জন্য পুরষ্কৃত করা হয়। অথচ ২০১২ সালের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২১ আগস্টের আক্রমণটি ছিল একটি বিশাল ষড়যন্ত্রের ফসল। আর এ ষড়যন্ত্রটি করেছিল যৌথভাবে জঙ্গিগোষ্ঠী হুজি, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবশালী কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রলালয়, পুলিশ প্রশাসন, ডিজিএফআই, এনএসআই এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কয়েক জন দুষ্টু চরিত্রের কর্মকর্তা।
সুখের খবর, বিগত বছরের ১০ অক্টোবর গ্রেনেডে বোমা হামলা সংক্রান্ত মামলার রায় দেয়া হয়েছে। এতে দেখা যায়, ১৯ জনের ফাঁসি আর ১৯ জনের যাবজ্জীবনসহ আরো অনেকের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়েছে। যারা এর পেছনে কুশীলব ছিল তারা যথাযথ শাস্তি পেয়েছে; যে ছিল মাস্টারমাইন্ড-মূল পরিকল্পনাকারী তারও যাবজ্জীবন হয়েছে। এ বিচারের কারণে প্রমাণিত হলো, এদেশে সব সময় বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে না। ষড়যন্ত্রেরও বিচার হয়।
সব দেখেশুনে মনে হয়, এ জঘন্য আক্রমণটি করার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যাকে সরিয়ে এবং একই সাথে আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতানেত্রীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে দেশকে বিরোধী-নেতৃত্বশূন্য করা তথা আওয়ামীবিহীন করা, ঠিক যেভাবে তারা এর আগে ১৯৭৫-এ দেশের স্থপতিকেই সরিয়ে দিয়েছিল মহাষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। তারই কন্যাকে তারা কেন ছেড়ে দেবে? তিনি তো ছিলেন তখন তাদের জন্য বিশাল বাধার পাহাড়। এ ছাড়াও তারা চেয়েছিল বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসের রাজ্য হিসেবে গড়ে তুলতে যেখানে তারা সন্ত্রাস কায়েম রেখে জনগণকে শোষণ করতে পারবে।
কিন্তু ইতিহাস থেমে থাকে না, স্থবিরও থাকে না। চলমান ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য ঠিকই সঠিক জায়গায় আসন বিছিয়ে দিয়েছে। জাতির জনকের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ জনগণই তাকে দিয়েছেন এবং তিনি সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশকে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিতও করতে সক্ষম হয়েছেন। আর যারা ষড়যন্ত্র করে তাকে ২১ আগস্ট নিশ্চিহ্ন করতে অপতৎপরতা চালিয়েছিলেন তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষ শক্তির সরকারের প্রধান হয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোমা বিস্ফোরণের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। জোট সরকারের কূটকৌশল আর বোমা হামলার সাথে জড়িত সব প্রমাণ গায়েব করে দেওয়ার অপচেষ্টার পরও বিচারের প্রক্রিয়া ঠিকই শুরু হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। অভিযুক্তদের আট জন আছেন জামিনে, তেইশ জন কারাগারে আর আঠার জন পলাতক।
একুশে আগস্টের আসুরিক আক্রমণের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতির উপর যে অশুভ প্রভাব ফেলেছে তা নিরসনে বোমা হামলার প্রধান শিকার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজের ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা দিয়ে তার মোহনীয় ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে পজেটিভ ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু দেশবাসীকে এ ঘটনা অনাগত কাল ধরে তাড়িয়ে বেড়াবে। তবে এ ঘটনা থেকে একটি বিষয় আবারও স্পষ্ট হয়েছে যে, বোমার আগুনে দেশ জ্বালিয়ে রাস্তাঘাটে মানুষ মেরে নিঃশ্বাস বন্ধকরা রাজনীতি চর্চা করে কেউ পরিণামে জয়লাভ করতে পারে না।
লেখক : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়