দীপক চৌধুরী : বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের বাংলাদেশে সংক্রমণ, বিস্তৃতির সম্ভাব্যতা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বেসামরিক প্রশাসনের অনুরোধে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলো এবং উপকূলীয় এলাকায় ‘ইন এইড টু সিভিল পাওযার’ এর আওতায় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী নিয়োজিত থাকবে। আজ মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) থেকে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে সশস্ত্র বাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন। এদেশের মানুষ মনে করে, এই সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী।
করোনা মোকাবিলায় বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কী বলে তা আমরা জানি। সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া কোনো উপায় নেই। সারাদেশে গুজব ভর করেছে। কোথাও এর কোনো কূলকিনার নেই। কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা যার তিনি বিয়ে করেছেন বা করতে যাচ্ছেন। বোনের বাড়িতে বা শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেছেন। একশ্রেণির প্রবাস ফেরতরা ন্যূনতম সহযোগিতা করছেন না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংবাদ সম্মেলনেই উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা যাদের, সেসব প্রবাসী জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালাচ্ছে, দরজা ভেঙ্গে পালাচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম, একজন সিভিল সার্জন ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন নিজেই ওএসডি। অথচ তিনি জানতেন তাকে ধরা হবে। জনসমাগম হয় এমন সামাজিকতা না করবার জন্য বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে বেতার, টেলিভিশনে, গণমাধ্যমে। এই বৈশ্বিক সমস্যার কথা আমরা সবাই জানি। দুঃসময়ে জনগণের মঙ্গলের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরামহীন কাজ করছেন, সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একের পর এক বৈঠক করছেন, বারবার প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। অথচ অন্যদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারের অস্তিরতা শুরু হয়েছে। অসহায় মানুষকে জিম্মি করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা কাড়ি কাড়ি টাকার পাহাড় বানাচ্ছেন। এমন ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে তারা কী টাকা নিয়ে কবরে যাবেন। করোনাভাইরাস তো বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা সিপিবি বুঝবে না। এটি সবার জন্য সমান। কখন যে কাকে সংক্রমণ করে তা কেবল করোনাভাইরাস জানে। দেশে দুর্যোগ এলে, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রসঙ্গ এলে গ্রেপ্তার এড়াতে বিদেশে পালিয়ে লুটেরা, কালোটাকাওয়ালারা, দুর্নীতিবাজেরা রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু এবার তো সেই সুযোগ নেই। নেই পালাবার পথ। করোনাভাইরাসের হাত থেকে কারো রক্ষা নেই। এই ভাইরাস ধনি-গরিব চেনে না। ইউরোপের দেশে দেশে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক, মৃত্যু প্রতিদিন।
করোনাভাইরাসের মহামারির সঙ্গে এখন মিশেছে গুজব। চলছে ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ, আরেকটা গুজবের সঙ্গে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা দ্বারা সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসা এ মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই, তবু বানোয়াট চিকিৎসার খবরে ফেসবুক ছেয়ে যাচ্ছে। ভুয়া খবরে বিভ্রান্ত হয়ে অ্যালকোহল, গরম পানি, ভিনেগার ইত্যাদি গিলে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা বিরাজ করছে। ফেসবুকের গুজব ও ভুয়া খবরে আক্রান্ত হচ্ছেন সমাজের নানা স্তরের মানুষ। ইন্টারনেটের কল্যাণে প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে উদয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ তথ্য। কোনটি বিশ্বাস করা উচিৎ কোনটি নয় তা আমরা বুঝতে চাই না। বিবেচেনাও করি না। ‘বিশ্বাস’ কিংবা ‘অবিশ্বাস’ নিয়ে যে মরণখেলা শুরু হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তে প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী নামানো একটি উত্তম সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশে করোনা মোকাবিলা করতে হলে করোনা গুজব মোকাবিলায় আমাদের দক্ষ ও কঠিন হতে হবে। সে জন্য গুজব শনাক্তকরণ ও বিচারমূলক চিন্তায় দক্ষতা আমাদের দরকার। ছাপার অক্ষরে কিংবা কম্পিউটার বা মোবাইল স্ক্রিনে যা থাকে, তার সবই সত্য নয়, আবার সব মিথ্যাও নয়।
পুলিশের হিসাবে মার্চের প্রথম ২০ দিনে বিদেশ থেকে ফিরেছেন ২ লাখ ৯৩ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এসেছেন কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেশগুলো থেকে। বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই যার যার বাড়িতে তারা চলে গেছেন। এদের মধ্যে মাত্র ১৮ হাজার বিদেশফেরত স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিনে আছেন। অন্যদের কোনো হদিস নেই। এই বিদেশফেরতদের মধ্যে কেউ সংক্রমিত হয়ে থাকলে তা কত মানুষের মধ্যে ছড়াবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণাই করা যাচ্ছে না। ফলে ‘ভয়ংকর পরিণতি’র আশঙ্কা করেন কেউ কেউ। শুধু বলব, আমরা জয় করতে চাই এ বিপদকে। সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই প্রার্থনা।
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, কথাসাহিত্যিক