ইসরাত জাহান উর্মি : এই লেখাটা যখন লিখছি চোখে ভেসে ওঠছে আমার এক সহকর্মীর করা একটি নিউজ স্টোরিতে একটা ছোট্ট ইন্টারভিউতে একজন নারীর মুখ। ঠিক ইন্টারভিউও না, আমরা নিউজ চ্যানেলের ভাষায় বলি, ভক্সপপ। ভয়েস অব পিপল। সিটি ইলেকশন নিয়ে করা ওই স্টোরিতে নারীটি বলছিলেন, ‘গ্যাস থাকে না, সময়মতো রানতে পারি না, ঠিক সময়ে রাইন্ধা না দিতে পারলে স্বামী মারে’ । নারীটির ওই বয়ান আমার শরীরে চাবুকের মতো লাগে। এককথায় একটা শহরের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক কী তা যেন বুঝিয়ে দেয় এই লাইনটি। গ্যাস না থাকলে, পুরুষের জন্য রান্না না করে দিতে পারলে কীভাবে নির্যাতনের শিকার হয় নারী। যদি এই বয়ানটিকে ধরে আগাই লেখার ভাবনাটা তাহলে কী দাঁড়ায়? বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড ১৪ বছর ধরে কাজ করছে ‘নিরাপদ নগরী, নির্ভয় নারী’ এই শিরোনামে। গবেষণায় বলা হচ্ছে, নিরাপদ নগরী সেটাই যেখানে নারী সহিংসতার শিকার হন না, নারী নিজেকে একঘরে মনে করেন না। ভয় বা হয়রানি ছাড়া জীবনযাপন করেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর পানি পান। মনের আনন্দের জন্য বিভিন্ন বিনোদনে অংশ নিতে পারেন। নারী বলতে তিনি এই শহরে জন্ম নিয়েছেন হতে পারেন, অভিবাসী হতে পারেন বা ছাত্রী ও পর্যটক হতে পারেন।
এই শহরটিকে কি নারীরা নিরাপদ ভাবেন? এ কথা লেখাই বাহুল্য যে ১০০ ভাগ নারীই হাত তুলে বলবেন, তারা নিরাপদ মনে করেন না। শুধু নারী হওয়ার অপরাধে এই শহর তাকে এই ঊণতার বোধ দ্যায় যে সে সমান নাগরিক নয়। এ শহরে স্তনে চাপা না খেয়ে কোনো মেয়ে গণপরিবহনে উঠতে পেরেছে? বাসের সহকারী শরীরের স্পর্শকাতর কোনো জায়গাটিতে হাত না দিয়ে গাড়িতে তুলেছেন কোনো নারীকে? রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে গণপরিবহনের কোনো চালক বা স্টেকহোল্ডারটি তাকে মনে করেনি সে স্রেফ একটা ‘মাল’ একটা ‘পণ্য’ একটা ‘ভোগ করা যায় এমন জিনিস?’ এই গণপরিবহনে পুরুষের পা চ্যাগিয়ে বসা বা জামা ব্লেড দিয়ে কেটে হাত ঢোকানো থেকে শুরু করে মাস্টারবেট করাসহ নানান বিকৃতির অত্যাচারে একবার ছোট্ট একটা ক্যাম্পেইন হয়েছিলো, ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’-সেই ক্যাম্পেইন এর ফলে নারীদের কী কী শুনতে হয়েছিলো নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের। ব্রাকের গবেষণা বলছে, শতকরা ৯৪ ভাগ নারী গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হন। গণপরিবহনে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন গতবছর কতো নারী তার হিসাবটা নেই, ২০১৮ তে হয়েছিলেন ১৩ মাসে ২১ নারী। কতো নারী এই শহরে শুধু ইউরিন পাবে বলে পানি না খেয়ে সারাদিন কাটান? অ্যাকশন এইড বলছে, ৯৬ শতাংশ নারী গণশৌচাগার ব্যবহার করেন না। এবার আসুন পার্ক বা খোলা জায়গা অথবা চিত্তবিনোদনের জায়গা। এই শহরে সিনেপ্লেক্সগুলো ছাড়া কোনো সিনেমাহলে নারী একা যেতে পারবে? থিয়েটার দেখে রাত দশটায় একা গণপরিবহনে ফিরতে পারবে নির্ভয়ে? ২০১৮ তে একজন নারী সিএনজি অটো রিকশায় ফেরার সময় পুলিশের দ্বারা হেনস্থা হওয়ার ভিডিওটির কথা মনে করুন। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সংবেদনশীল পুলিশ কতোজন আছেন আমাদের দেশে?
এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ভোট হচ্ছে এই শহরে। প্রার্থীরা যা যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তার মধ্যে আমি অন্তত নারীর অংশ খুব একটা খুঁজে পাই না। এইখানে নারী কাউন্সিলরকে নিয়ে স্লোগান হচ্ছে, ‘যতো চিপবেন ততো রস, চামেলী আপার আনারস’। এইখানে নারী কাউন্সিলররা একধরনের বিনোদনদাত্রী হিসেবে আবির্ভূত। এ পর্যন্ত ইশতেহার দিয়েছেন তিন মেয়র প্রার্থী। আতিকুল ইসলাম ৩৮ দফা, তাবিথ আউয়াল ১৯ দফা আর ইশরাক হোসেন ১৬ দফার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইশতেহার দিয়েছেন। এইসব ইশতেহারের কোথাও নারীর সমস্যাকে আলাদা করে চিহ্নিত করে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের উত্তরে কেউ কেউ নারীবান্ধব শহর গড়ে তুলবেন বলে উত্তর দিলেও তা কীভাবে তার কোনো পরিকল্পনা স্পষ্ট জানাননি। নারী মূলত সেকেন্ড সিটিজেন। নারী মূলত ঊণমানুষ। তাই তাদের কথা আলাদা করে মাথায় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তারা বোধ করেননি। আমি তাদের দোষ দিই না। পিছিয়ে পড়া বা পিছিয়ে রাখা যেকোনো জনগোষ্ঠীকেই আসলে আন্দোলন আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের অধিকারের কথা শাসকদের কানে পৌঁছে দিতে হয়। সেই জায়গায়টায় হয়তো খামতি আছে আমাদেরও। নভেম্বরে সিক্সটিন ডেজ অ্যাক্টিভিজমের সময় ভারতের কোনো একটি প্রতিষ্ঠান নির্মিত একটা ভিডিওর কথা মনে পড়ছে।
নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক পরা একটি মেয়ে কাজশেষে ক্লান্ত পায়ে অনেক রাতের শহরে ফিরছে একলা গন্তব্যে। সেই শহরে মাস্তান আছে, মাতাল আছে, রাতের যতো অনুষঙ্গ সব আছে, কিন্তু শুধু ‘নারী’ হিসেবে সে অনিরাপদ নয়, পুরুষকে যেসব বিপদের কথা ভাবতে হয় না, তাকেও সেসব ভাবতে হচ্ছে না-এরকম ছিলো ভিডিওর মূলকথা। খুব ছোট একটা বিষয় কিন্তু এইটুকু অর্জনও আমাদের-এই ঢাকা শহরের নারীদের কাছে বিরাট এক স্বপ্ন। কে, কারা এবং কী আমাদের অনিরাপদ করে তোলে? আমরা কি সেইসব সিস্টেম আর মানসিকতার দিকে আঙুল তুলি? আমাদের মেয়ররা কি আঙুল তোলেন? যদি না-ই তোলেন কেন সেইসব নগরপিতা হতে চাওয়া বা হতে চলা পুরুষদের আমরা নারীরা ভোট দেবো? নিজেকে প্রশ্ন করুন। ফেসবুক থেকে