চিররঞ্জন সরকার : বাংলার বয়াতি-বাউল-ফকিররা আমাদের দার্শনিক। তারা তাদের গানের মাধ্যমে, জীবন চর্চার মধ্য দিয়ে দার্শনিক প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন, দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। নানা মত, পথ ও তত্ত্বের অনুসারী সাধক যারা সত্যের অনুসন্ধান করেছেন এবং তাদের উপলব্ধিকে গানের ভাষায় প্রকাশ করেছেন আমাদের কাছে মোটাদাগে তারাই ‘বাউল’। ‘বা’ মানে বাতাস (সংস্কৃত বায়ু=বাংলা ‘বাই’, ‘বাউ’), আর ‘উল’ মানে সন্ধান। বাতাসের সন্ধান। এই যে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে বাতাস আসা- যাওয়া করছে এরই সন্ধান করা। বাউল সাধনার মূল কথা হচ্ছে একজন মানুষের ভিতরে এক অসীম মানুষ বাস করছে। সেই অসীম মানুষটার নৈকট্য পেতে হলে তাকে সাধন করতে হবে। ‘মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার, ভবে সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার’। এই সাধনা করলে মুর্শিদ, রাসূল, খোদা সবার সন্ধান পাওয়া যাবে। মানুষের মধ্যেই স্রষ্টাকে অনুভবের চেষ্টা করেন বাউলরা। যেমন লালন করেছেন, ‘যে মুর্শিদ সে-ই রাসূল, এতে নেই কোনো ভুল, খোদাও সে হয়। এমন কথা লালন কয় না কোরআনে কয়’।
বাউলরা কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্ম বিশ্বাসকে বড় করে দেখেন না। তাদের কাছে সব ধর্মই সমান গুরুত্বপূর্ণ অথবা গুরুত্বহীন। ‘কেউ বলে আছে খোদা, কেউ বলে নাই আমি বলি থাকলে থাকুক না থাকিলে নাই।/ যারে নয়নেও দেখি নাই, শ্রবণেও শুনি নাই,/কেমনে আছে বলো করি প্রমাণ, শোনো দ্বিজ দাসের গান’। তারা মনে করেন ‘ও করো মানুষ ভজন মানুষ পূজন, অর্ঘ্য দাও মানুষের পায়। এ মানুষ ভজিলে বংশে মানুষ পাওয়া যায় রে’। লালন জানাচ্ছেন, ‘স্বরূপে রূপ দেখ সংক্ষেপে’, অর্থাৎ মানুষের ভিতরেই খোদা, মানুষের আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই, আপনাতে আপনি ফানা বা সমাধি হলেই সেটা জানা যাবে। বড়ু চ-ীদাসের ভাষায়, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। বাউল তাই মানুষ ভজনা করে। এ মানুষ নিজেকে আশরাফুল মাখলুকাত বলে মনে করে। এই বাউল-বয়াতি-সাধকরা খুবই নিরীহ। তারা নিজেদের মতো থাকেন।
নিজেদের কথা বলার চেষ্টা করেন। তাদের একটাই ধ্যানজ্ঞান : সত্য বল সুপথে চল, ওরে আমার মন। কিন্তু সত্য বলার, সুপথে চলার দেশ তো বাংলাদেশ নয়। এখানে সমাজিক পরিম-ল থেকে রাষ্ট্রীয় চৌহদ্দিজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অজস্র-অসংখ্য ধর্মের ষাঁড়। এই ষাঁড়েরা নিরীহকে গুঁতাতে না পারলে শান্তি-স্বস্তি পায় না। নিজেদের ধর্ম ব্যবসা আর পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার বিদ্যায় কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা দেখলেই তারা শিং উঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই তো এই ‘ধর্মের ষাঁড়ের দেশে’ ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, ব্যাংক লুণ্ঠনকারী, নারী নির্যাতনকারী, মিথ্যাবাদী, ভ-, প্রতারক, ওয়াদাখেলাপিরা দাপটের সঙ্গে থাকেন। কিন্তু প্রচলিত মতের বাইরে কথা বলার কারণে শরিয়ত সরকার নামে এক বয়াতিকে গ্রেপ্তার করা হয়, রিমান্ডে নেয়া হয়। আসুন আমরাও ধর্মের ষাঁড় হয়ে যাই, ঘাস-বিচালি চিবাই আর একে-অপরকে শিং দিয়ে গুঁতা মারি। কবি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?’ হ্যাঁ আমরা চাই, খুব বেশি করে চাই। ফেসবুক থেকে