শিরোনাম

প্রকাশিত : ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯, ০৬:৩৬ সকাল
আপডেট : ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯, ০৬:৩৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

গাম্বিয়া গ্যাম্বল ও সুচি কাকি

বিল্লা মাসুমের ফেসবুক থেকে: সুচি কাকি আজ কি বলবেন তাই ভাবছি। আইনের ছাত্ররা মুট করে। প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডাতে তাদের মতো হয়তো সুচি বলবেন আদালতের এখতিয়ার নেই, সেনাবাহিনী শুধু সন্ত্রাস দমন করেছে, গাম্বিয়ার তাতে কি, রোহিঙ্গারা আমাদের নাগরিক নন ইত্যাদি।

তা তিনি বলুক। তবে একটা বিষয় কিন্তু আমাদের স্বীকার করতে হবে, বার্মা মামলা লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং সুচি আইসিজিতে নিজে যুক্তিতর্ক করে এই মোকদ্দমার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এদিক দিয়ে বর্বরতার বর্মে ঘেরা এবং মারের সংস্কৃতিতে বিশেষ করা মিয়ানমার একটা বিস্ময় উপহার দিয়েছে সত্যি। বাংলাদেশে জামাত-বিএনপিও যুদ্ধাপরাধ মামলা বুঝে-না বুঝে লড়ছে এবং হেরেছে। মিয়ানমারেরও তাই হবে অনুমান করা যায়। অবশ্য তাদের সিরিয়াসনেস এর অভাব নেই, কানাডিয়ান প্রফেসর কে তারা ডেকেছেন, শুনতে পাচ্ছি আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল আইনের বাজ পাখি শাবাজ ক্যালান্ডার কেও তারা ডেকেছেন।

গাম্বিয়ার পাশার দান চেতনায় ভাস্মর। এই কিছুদিন আগেও তাদরে রয়েছে ইয়াহিয়া নামক শাসকের দেয়া বাইশ বছরের নির্যাতন-আমলের ইতিহাস। অনেকটা পাকিস্তানের ইয়াহিয়ার মতো। দেশটির আইনমন্ত্রী আবু বকর সাহেব নিজেও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনের সমঝদার। তাই তিনি নিজেও সচলিত। সর্বশেষ, ওআইসির সম্মিলিত সমর্থন তাদের প্রেরণা দিয়েছে। আইসিসির এখতিয়ার সংক্রান্ত রায় এবং ফাতো বেনসুদার অনুসিন্ধান অনুমতি-ও তাদের ভাবনার খোরাক দিয়েছে। তাই আইসিজে তে যাওয়া গাম্বিয়ার গ্যাম্বল নয়, ওটা আমি রসিকতা করে বললাম। মনুষ্য সভ্যতার মহান একটি কাজ গাম্বিয়া করেছে, বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন আবু বকর।

গাম্বিয়া রেফারেন্সের প্রয়োজন কেন?

প্রশ্ন হলো আইসিসিতে ব্যাপারটা আছে, তাহলে গাম্বিয়াকে আইসিজিতে কেন যেত হলো? দুটো কারণে:

(১) গত বছর এই আইসিসির যে রুলিং তা ছিল তা হলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়ে। গণহত্যা নিয়ে নয়। বার্মা আইসিসি সংহিতার শরিক না। তাই গণহত্যার অভিযোগে তাকে বা তার (অ )মানুষকে ধরা যাচ্ছিলো না। তাই বেনসুদা-রা একটা মন্দের ভালো উপায় বের করেছেন। নালিশ এনেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের। এতে দেখানো গেছে যে, এই অপরাধের একটা দিক হলো জোর করে মানুষ খ্যাদানো, এক্ষেত্রে বার্মা থেকে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যেহেতু আইসিসির শরিক দেশ, আর অপরাধের একটা অংশ সম্পন্ন হয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে, তাই আইসিসি তার এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পেরেছে এবং ফাতো বেনসুদাকে অনুমতি দিয়েছে অপরাধ তদন্ত করবার।

(২) আইসিসি দেখছে তামাতাদা আর সুচি দেড় মতো লোককে ডাকে উঠানো যায় কিনা, আর আইসিজে দেখবে রাষ্ট্র হিসেবে গণহত্যা প্রতিরোধে বার্মা বিরাট হয়েছে কিনা।

তাই কথা দাঁড়ালো, গাম্বিয়া মামলায় আইসিজে পরখ করছে বার্মার অবস্থা আন্তর্জাতিক বিচারিক মানদন্ডে জেনোসাইড হিসেবে বিবেচনা হবে কিনা।

কি চায় গাম্বিয়া?

গাম্বিয়ার চাওয়া খুব বেশি না। আমরা যা চাই তার চেয়ে কম-ও না। গাম্বিয়ার মূল চাওয়া দুটি: (১) আইসিজে বলুক যে বার্মা জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে এবং করছে ; এবং (২) আইসিজে যেন বার্মাকে নতুন করে গণহত্যায় নামতে নিষেধ করে এবং, গণহত্যার যে আলামত আছে তা ধ্বংস না করে। এই দুটি পোইন্টে জিততে হলে গাম্বিয়াকে ৩টি জিনিস প্রমান করতে হবে: (১) চক্ষু দৃষ্টি দেখা যাচ্ছে যে নালিশ জানানো বিষয়টাতে আইসিজের এখতিয়ার আছে , (২) গাম্বিয়ার (ক্ষতিগ্রস্তের) অধিকার এর সাথে চাওয়া প্রতিকার এর সম্পর্ক আছে , এবং (৩) চাওয়া প্রতিকার মঞ্জুর না হলে সমূহ বিপদ এবং অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। প্রমানের এই তিনটি মানদণ্ড ২০১১ শখের কোস্টারিকা বনাম নিকারাগুয়া মালাই সাব্যস্ত হয়ে আছে।

এখন, উপরের ১ নম্বর পয়েন্ট প্রমান করার জন্যে গাম্বিয়াকে দেখতে হবে যে বার্মার সাথে তাদের বিরোধ আছে (ডিসপুট, জেনোসাইড কনভেনশন এবং আইসিজে সংবিধি এই শর্ত আরোপ করে। মায়ানমার বলবে যে বাবা আবু বকর, তোমার গাম্বিয়ার সাথে তো আমার কোনো বিরোধ হয়নি। তাই তুমি আমাকে এইখানে নয় আসছো ক্যান? নামিবিয়া মামলায় (১৯৬২) আইসিজে বলে রেখেছে যে, পক্ষগুলো একে অপরকে সক্রিয়ভাবে বিরোধিতা করলে একটা "বিরোধ" আছে বলে আদালত ধরে নেবেন। গাম্বিয়া এই পয়েন্টে নিচের যুক্তি গুলো দেখাচ্ছে বা দেখাবে:

(১) জাতিসংঘ সত্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট, ওআইসির রিপোর্ট, সাধারণ পরিষদে দেয়া বিভিন্ন বিবৃতি ও তথ্যে গাম্বিয়া উদ্বিগ্ন। এবং এ বিষয়ে মায়ানমারকে গাম্বিয়া একটা নোট ভারবাল দিয়েছিলো যার উত্তর বার্মা দেয়নি। জাতিসংঘের মতো জায়গায় দেয়া উদ্বেগ, ব্যাখ্যা চেয়ে বার্মার নীরবতা একটা বিরোধের অস্তিত্ব" জানান দেয়। অবশ্য মায়ানমার বলবে যে , জাতিসংঘে দেয়া গাম্বিয়ার ভাইস-প্রেসিডেন্ট এর দেয়া ভাষণে বার্মা এবং জেনোসাইড এর উলকে নেই। এবং এই ব্যাপারগুলোর সাথে প্রতক্ষ্য বিরোধের কোনো যোগ নেই।

(২) জর্জিয়া বনাম রাশিয়া (২০১১) মামলায় আদালত বলে রেখছেন যে, কোনো বিরোধের অস্তিত্ব বলার ধরনের উপর নির্ভর করেনা , নির্ভর করে তার সর্বোত্তর উপরে এবং অপরাধ ঠেকাতে দৃশ্যমান ব্যর্থতার উপরে। আবার গাম্বিয়ার জন্যে আর পয়েন্ট হলো , মার্শাল আইল্যান্ড বনাম ভারত মামলায় (২০১৬) আইসিজে বলে রেখেছেন যে, যদি বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে, ঘটনা বিষয়ে কোনো পক্ষ অন্য পক্ষের অবস্থানকে অনুমোদন করেনা, তাহলে ডিসপুট আছে বলে অনুমান করে নেয়া হবে।

দেখা যাচ্ছে, এই পয়েন্টে গাম্বিয়ার যুক্তির ধার বেশি থাকবে। এবঙ বিশ্ব আদালত পরবর্তী পয়েন্টে মন দেবেন।

২য় পয়েন্ট হলো, প্রার্থিত প্রতিকার এর সাথে সুসংহত অধিকারের সংযোগ দেখতে হবে। প্রথম কথা হলো, রোহিংগারা জনগোষ্ঠী হিসেবে বাশ করার অধিকারী। এমনকি অধিকারী না হলেও, গণহত্যা থেকে সুরক্ষা পাবার অধিকার তাদের রয়েছে। জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী পক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গাম্বিয়ার "এরগা ওমনেস" অধিকার বা সর্ব-উদ্বেগ অধিকার রয়েছে। এই অধিকার মতে জেনোসাইড কনভেনশনের পক্ষ ভুক্ত সকল রাষ্ট্রের অধিকার রয়েছে এত দেখার যে অন্য রাষ্ট্র কনভেনশন এর দায় এড়িয়ে যাচ্ছেনা। এই অধিকার ২০১২ সালের বেলজিয়াম বনাম সেনেগাল মামলাও পুনর্ব্যক্ত করেছে।

৩য় পয়েন্ট হলো, আদেশ বা প্রতিকার না পেলে সমূহ বিপদের শঙ্কা এবং অপূরণীয় ক্ষতির শঙ্কা। শেষ দুইবার ২০১৭ এর অক্টোবর এবং ২০১৮ এর অগাস্ট এ রোহিঙ্গা নিধন হলো। ১০ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া, দেশ ছাড়া , লক্ষ্ নারী ধর্ষিতা হয়েছেন। তবুও ৬ লক্ষ মানুষ এখন আরাকে আছেন, তাদের অবস্থা? গণহত্যা আবার হতে পারে। এর চেয়ে উপস্থিত আর অপূরণীয় ক্ষতির ব্যাপার আর কি আছে?

তাই আশা করা হচ্ছে, আদালত বার্মার গণহত্যা দায় নিশ্চিত করে একটা রায় দেবেন। যেহেতু রায় পেতে সময় লাগবে, তাই একটা আপাতত আদেশ ও দেবেন। অবশ্য আপাতত আদেশ কতদিনে দেবেন তার ঠিক নেই। চর্চা হচ্ছে ৪ থেকে ১৫ সপ্তাহের মধ্যে। আমার ধারণা, পরিস্থিতি বিবেচনায় একটা আপাত করোনিয়র তালিকা সুচি কাকীর হাতে উপস্থিত ধরিয়ে দেয়া হবে।
তাতে আর মাদেকি?

গাম্বিয়ার অন্তর্বর্তী আদেশে অনেক কিছু থাকতে পারে। এটাও থাকতে পারে যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে নিরাপদ পরিবেশ দাও।

আর হে সুচি, ভেতরের মানুষটাকে রোদে দাও। না হলে, গণহত্যার অভিযোগে এবার যদি হেগে এস, এবার আর আইসিজিতে ডিফেন্ড করতে আসতে হবে না, এবার ১০ কিলোমিটার দুরের আইসিসিতে আসামি হিসেবে আসতে হবে। সাথে জেনারেল তামাতাদা কে নিয়ে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়