আমাদের সময় : অ্যাননটেক্স গ্রুপ। কর্ণধার ইউনুস বাদল। নামে-বেনামে ২২টি প্রতিষ্ঠান খুলে জনতা ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। অনিয়ম-দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া এসব ঋণের অর্থ ফেরত দেননি। এখন ব্যাংকিং খাতের নাম্বার ওয়ান খেলাপি ইউনুস বাদল। জনতা ব্যাংকের মতো অন্য একাধিক ব্যাংক থেকে ইউনুস বাদলের কায়দায় হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অন্য শীর্ষ খেলাপিরা। এভাবে শীর্ষ ২০ খেলাপির পকেটেই রয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা; গত ডিসেম্বর যা ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত বছরের ডিসেম্বরে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা ছিল ৪০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা; চলতি বছরে সেপ্টেম্বরে যা বেড়ে হয়েছে ৫৪ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে পাওনা বেড়েছে ১৪ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট
বৃদ্ধির ৬৫ শতাংশ বেড়েছে শীর্ষ খেলাপিদের কারণে। ওই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শীর্ষ খেলাপিদের কাছে পুঞ্জীভূত পাওনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। গত ডিসেম্বরে মোট খেলাপি ঋণের ৪৩ শতাংশ ছিল শীর্ষ ২০ খেলাপির পকেটে। এখন শীর্ষ ২০ খেলাপির পকেটে রয়েছে ৪৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বড় কিছু গ্রাহকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত। বিভিন্ন উপায়ে তারা ঋণের নামে প্রচুর টাকা বের করে নিয়েছেন এবং নানা কাজে লাগিয়েছেন; কিন্তু ফেরত দিচ্ছেন না। ঋণ ফেরত দেওয়ার আন্তরিকতাও তাদের মধ্যে দেখা যায় না। এসব ঋণের বিপরীতে যে জামানত নেওয়া হয়, তা-ও পর্যাপ্ত নয়। ফলে মামলা করেও ঋণ আদায় করা সম্ভব হয় না।
অ্যাননটেক্স গ্রুপের মতো আরেক শীর্ষ খেলাপি ক্রিসেন্ট গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে ঋণ নিয়েছেন আবার ভুয়া কোম্পানির কাছে রপ্তানি করে সেই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। দেশের শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকায় ক্রিসেন্ট গ্রুপের নাম দ্বিতীয়। আরেক শীর্ষ খেলাপি চট্টগ্রামের শাহাবুদ্দিন আলমের এসএ গ্রুপ। ২৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, যার পুরোটাই এখন খেলাপি। আরেক খেলাপি মোস্তাফা গ্রুপের চেয়ারম্যান হেফাজতুর রহমানের কাছে ৩১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা দেড় হাজার কোটি টাকা।
জাতীয় পার্টি নেতা মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম ক্রিস্টাল গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ১২টি ব্যাংকের পাওনা ৪ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক জালিয়াতির আলোচিত হলমার্ক গ্রুপ। সোনালী ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া শীর্ষ খেলাপির তালিকায় আছে বিসমিল্লাহ গ্রুপ, নূর জাহান গ্রুপ, অটোবি, ইলিয়াস ব্রাদার্স, কেয়া গ্রুপ ইত্যাদি।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রভাবশালীদের অনেকেই ঋণ নিয়ে এখন শীর্ষ খেলাপি। আমরা বরাবরই বলে আসছি খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের প্রধান সংকট। খেলাপি ঋণ কমে গেলে সুদহার কমে যাবে। তাই খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। তা হলে খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় সম্ভব হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপিদের তালিকা আলাদাভাবে সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের মার্চে অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক সব ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপিদের কাছে পাওনা ও আদায়ের কৌশল সংগ্রহ করেছে। জুলাই ও সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে আদায়ের চিত্র সংগ্রহ করা হয়েছে; কিন্তু তাতে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
একক গ্রহীতার কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ তুলে দিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো উদারহস্তে খেলাপিদের পকেটে টাকা তুলে দিয়েছেন। সম্প্রতি বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক আগ্রাসীভাবে ঋণ দিতে গিয়ে একই গ্রাহককে বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকের, ২১ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। এই ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তারা গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশ করে অ্যাননটেক্স গ্রুপকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপকে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন। গ্রাহকরা সহজেই ঋণের টাকা পেয়ে তা পাচার করেছেন এবং অপব্যবহার করেছেন। শীর্ষ ২০ খেলাপির পকেটে ১৪ হাজার কোটি টাকা তুলে দিয়েছে জনতা ব্যাংক।
হলমার্ক গ্রুপের অকুস্থল সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকে আছে ৩ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট ১২ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ২৮ দশমিক ৫০ শতাংশই আটকে আছে শীর্ষ ২০ খেলাপির পকেটে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আরেক ব্যাংক রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ-২০ খেলাপির পকেটে ২৫০০ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছরের মেয়াদে পুনঃতফসিল এবং এক বছরের মধ্যে এককালীন পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে হাজার চারেক আবেদন পড়েছে। তবে সেখানে শীর্ষ খেলাপিদের বেশি সংখ্যক আবেদন এসেছে।