তৌহিদ হোসেন : চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ যেভাবে এগুচ্ছে তাতে আরেকটি বিশ্ব মন্দা দরজায় কড়া নাড়ছে। বিশ্লেষকরা মন্দার হুঁশিয়ারি দিলেও বড়ো অর্থনীতির দেশগুলো তাতে কর্ণপাত করছে না। এই মন্দার প্রভাব পুরো বিশ্বেই পড়বে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ নানা ফোরামে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে আসার পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে। বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বিশ্ব বাণিজ্যের গতিও কমে আসছে। এটা দীর্ঘায়িত হলে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদে কিছুটা লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন করে চীন-মার্কিন দুই দেশই পালটা পালটি শুল্ক আরোপ করছে। সম্প্রতিকালে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদায়ি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি ৪০ বিলিয়ন অর্থাত্ ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় চার শতাংশ বেশি রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ গার্মেন্টস খাত থেকে এসেছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি মূলত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর। রপ্তানির ৮২ শতাংশই যায় এ দুইটি বাজারে। এসব বাজারে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা রপ্তানি তথা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইত্তেফাক
এ বিষয়ে জানতে চাইলে, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যদি মন্দা শুরু হয় সেক্ষেত্রে রপ্তানির বড়ো বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে সাধারণ মানুষের ভোগ ব্যয় কমে আসবে, কর্মসংস্থানও কমে আসবে। সেক্ষেত্রে তাদের আয় ও চাহিদা কমবে। এ অবস্থায় আমাদের রপ্তানি পণ্যের অর্ডার কমে যেতে পারে। বিশ্বমন্দা শুরু হলে এর প্রভাব চীনের বাজারেও পড়বে। কারণ বিশ্ববাজারে চীনা পণ্যের আধিপত্য রয়েছে। তাদের পণ্য বিক্রি কমে গেলে এর প্রভাব পুরো বিশ্ববাজারে পড়বে। চীনা কারখানাগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশে স্থানান্তর হবে। তবে আমাদের উত্পাদন সীমাবদ্ধতার কারণে মাঝারি ও ভারী শিল্প স্থানান্তর হয়ে আসা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তুরস্ক, ভিয়েতনামের মতো দেশ বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে আরো বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। কীভাবে বড়ো বিনিয়োগ নিয়ে আসা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। এর পাশাপাশি তৈরি পোশাক নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি বহুমুখীকরণে উদ্যোগ নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
উল্লেখ্য, আইএমএফ সম্প্রতি বিশ্ব অর্থনীতির পূর্বাভাস প্রতিবেদনে এবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুই দশমিক ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিলেও আগামী বছর ২০২০ সালে এটি এক দশমিক নয় শতাংশে নেমে আসবে বলে অনুমান করেছে। এর মূল কারণ হিসেবে আইএমএফ বলছে, চীনসহ বিভিন্ন দেশের আমদানি পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ করায় মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে আসবে, যার প্রভাব দেশটির প্রবৃদ্ধিতে পড়বে। অনেক দেশের পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে চীনা পণ্যে। আইএমএফ বলছে এর প্রভাব চীনেও পড়বে। এবছর চীনে ছয় দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও আগামী বছর এই হার ছয় শতাংশে নেমে আসবে। শুধু বাণিজ্য বিরোধই নয়, যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট নিয়ে চলমান সংকট এবং বহু দেশে ঋণ বেড়ে যাওয়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ। ইউরোপ, আমেরিকা বাংলাদেশের জন্যে সবচেয়ে বড়ো বাজার হওয়ার কারণে সেখানে কোনো মন্দা দেখা দিলে কিংবা সেই মন্দাবস্থা ছড়িয়ে পড়লে, তার প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের শিল্পের ওপর পড়বে। শুধু তৈরি পোশাক শিল্পেই নয়, বাংলাদেশের বড়ো সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পও রপ্তানিতে অবদান রাখতে পারছে না। ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দুই অর্থবছর ধরে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ চামড়া ও চামড়া পণ্য রপ্তানি হলেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ১০১ কোটি ৯৭ লাখ ডলারে।
নতুন বাজারেও শঙ্কা:ইউরোপ আমেরিকার বাইরে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নতুন বাজারের তালিকায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, চীন, জাপান, ভারত, চিলি, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্কসহ আরো কয়েকটি দেশ। নতুন বাজারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়েছে জাপানে। গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) দেশটিতে ২৯ শতাংশ বেড়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১০৯ কোটি ডলারের। কিন্তু গত জুলাইয়ে আইএমএফ-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক পূর্বাভাস প্রতিবেদনে এসব দেশ নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে বড়ো অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি অল্প হলেও কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে জার্মানি এবং জাপান উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ব্রাজিল, মেক্সিকো, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাও রয়েছে। এসব দেশের প্রবৃদ্ধি কমে আসলে তার প্রভাব আমদানি-রপ্তানিতেও পড়বে। ইউরোপের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে গ্রিস। ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা যায় গ্রিসে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাড়ে ১৩ শতাংশ তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে বাংলাদেশের। রোমানিয়াতে কমেছে সাড়ে ৬ শতাংশ। নতুন করে শুল্ক আরোপ করায় তুরস্কে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১৩ শতাংশ। যদিও সার্বিকভাবে ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সম্পাদনা : খালিদ আহমেদ
আপনার মতামত লিখুন :