লাভা মাহমুদা : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালির জীবনে যখন অভিশপ্ত দিন নেমে আসে তখন আমি ছিলাম নিতান্তই শিশু। কতো বড় অঘটন ঘটে গেছে বুঝতেই পারিনি সেদিন। আমাদের বেড়ে ওঠার কালটা ছিলো অন্য রকম। তথ্য গোপনের কাল, ইতিহাস মুছে দেবার কাল। কীর্তি-ঐতিহ্য ভুলিয়ে দেবার পাগলা হাওয়া বইয়ে দেয়ার অপচেষ্টার কাল। চলছিলো সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার সব ধরনের অপকৌশল। কিন্তু ইতিহাস পথ হারায় না। মানুষকে সাময়িক বিভ্রান্ত করে মাত্র। ইতিহাসই উন্মোচন করে দেয় প্রকৃত সত্য। কারণ একটা সময় পর্যন্ত মানুষকে বিভ্রান্ত করা গেলেও চিরদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায় না।
বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির পিতা শেখ মুজিবকে হত্যা করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় নেয়ার ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে সময় লেগেছে, অনেক লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে, ¯্রােতের বিপরীতে নৌকা বাইতে হয়েছে, কিন্তু তরী পুরোপুরি ডোবার আগেই ঘাটে নোঙর করা সম্ভব হয়েছে। শেখ মুজিব এমন একটি নাম যা মানুষের মনে সাহস জোগায়। বাঙালির সাহসের আরেক নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২০ সালের ১৭ এপ্রিল টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লীতে বেড়ে ওঠা দুরন্ত কৈশোরের সেই বালকটি কালের পরিক্রমায় ইতিহাস সৃষ্টি করে নিজেই হয়ে ওঠেন ইতিহাস। দরিদ্রতার মধ্যে বেড়ে না উঠলেও গ্রামীণ জনপদের দারিদ্র্েযর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন সেই ছোটবেলা থেকেই। মানুষের অভাব, দরিদ্রতা তাকে ছুঁয়ে যেতো, কষ্ট দিতো, তাড়িত করতো। মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, সংবেদনশীলতা, ভালোবাসা তার চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিলো। তাই তো মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন সেই স্কুল জীবনেই। জেলও খেটেছেন সেই বালক বেলাতেই। রাজনীতি তার মননেই ছিলো। রাজনীতির জন্যই তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন, রাজনীতির কাছেই ছিলো তার আত্মসমর্পণ।
১৯৪৮ থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এই ভূখ-ের সকল আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন সংগঠক হিসেবে এবং নেতৃত্বে। তার চলার পথ বকুল বিছানো ছিলো না। বন্ধুর পথে চড়াই উৎরাই অতিক্রম করেই তিনি পেয়েছিলেন বাঙালি জাতির অকৃত্রিম ভালোবাসা। জেল জুলুম ছিলো তার জীবনের নিত্যসঙ্গী। জীবনের তেরোটি বসন্ত ছিলো কেটেছে কারাভ্যন্তরে।
জীবনের পাঠশালা থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্রমাগত নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন, অতিক্রম করেছেন। অতিক্রম করেছেন তাদের... যাদের কাছ থেকে রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন। কারও তৈরি করা পথ দিয়ে নয়, বরং নিজেই পথ তৈরি করে ধীরে ধীরে এগিয়েছেন ক্রমাগত সামনে। মানুষের মধ্যে থেকে, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির ইমারত গড়ে তুলেছিলেন বলে তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। আর তাই তার সরলতা যেমন মানুষকে ভালোবাসা, দুর্বলতাও মানুষকে ভালোবাসা। পুঁথিগতবিদ্যায়, বুদ্ধিমত্তায়, সৃজনশীলতায় সেরা বাঙালি হয়তোবা আরও পাওয়া যাবে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো অসম সাহসী, দূরদর্শী এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী রাজনৈতিক নেতা খুব বেশি নেই। তাই তো বিবিসির জরিপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অতিক্রম করে তিনিই হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
প্রতিটি মানুষের জীবনের পরতে পরতে যেমন উপলব্ধি আসে, বঙ্গবন্ধুরও তাই হয়েছিলো। অবশ্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি আরও জটিল। কারণ অনেক সময় ঘটনা না ঘটলে বোঝার উপায় নেই যে, কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক। পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক থাকলেও ৪৭-এ দেশভাগের অব্যবহিত পরই তিনি যখন বুঝতে পারলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়াটা ছিলো ঐতিহাসিক ভুল, তখন থেকেই শুরু হয় তার জীবনের বাঁক পরিবর্তনের লড়াই। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কীর্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দান। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি সবসময় শোষিতের কথা বলতেন, বঞ্চিতের কথা বলতেন, নিপীড়িতের কথা বলতেন। তাই তো সমাজের শোষক শ্রেণির চক্ষুশূলে পরিণত হলেন। তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের এক নেতার আকাশ ফুঁড়ে মহাকাশ ছোঁয়াকে পৃথিবীর বড় দেশের বড় নেতারা সহজভাবে নিতে পারেনি। তার খ্যাতি, তার জনপ্রিয়তা তাদের সহ্য হলো না। তাই তো জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাকে হত্যায় সক্রিয় হয়ে উঠলো ঘাতক চক্র। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিলো দেশের মানুষের তার প্রতি প্রবল আবেগ। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে কঠোরভাবে যে সিদ্ধান্ত নেয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর এই আবেগের কারণেই রাষ্ট্র পরিচালনায় কঠোর হতে পারেনি, শক্ত হাতে দমন করেননি... এমনকি মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদেরও। আর ছিলো মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। তাই তো তার জীবন শঙ্কার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিলেও বিষয়টি তিনি একেবারেই আমলে নেননি। সেই সুযোগেই ঘাপটি মেরে থাকা ঘাতকের দল হত্যা করলো স্বাধীন বাংলার স্থপতি, মহানায়ক, ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে।
সারাজীবন সংগ্রাম করে স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিলেন যে মহানায়ক... তাকে আমরা বাঁচতে দিলাম না, এ দেশ তাকে ধারণ করতে পারলো না। কী অকৃতজ্ঞ জাতি আমরা। পরিবারের শেষ সন্তানটিকে পর্যন্ত বাঁচতে দিলাম না। এমনকি হত্যা পরবর্তী সময়ে তার নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করা যেতো না, ইতিহাসের সব থেকে কালো আইন দ্বারা রুদ্ধ করা হয়েছিলো তার হত্যাকা-ের বিচারের সমস্ত পথ।
তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, মহাকালের মহানায়ক। এ দেশের মানচিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার জীবন। এ জাতির ভাগ্য এবং দুর্ভাগ্যের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে তার জীবন। শত চেষ্টা করেও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়নি তার নাম, তার অর্জন। মহাকালের পরিক্রমায় যতোদিন এ ভূখ- থাকবে, ততোদিনই তার নামটি রক্তের অক্ষরে লেখা প্রতিটি হৃদয়বান বাঙালির হৃদয়ের গভীরে।