ডঃ শোয়েব সাঈদ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপানি অর্থনীতি আর প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শিনশুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এমএস,পিএইচডি আর পোস্টডকের সুপারভাইজিং অধ্যাপক প্রয়াত তাকামিতসু ইউরিফুজি একদা বলছিলেন আনবিক বোমা নিক্ষেপে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ আর যুদ্ধে অপমানজনক পরাজয়ের পরও জাপানিরা আমেরিকানদের ঘৃণা করে না। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে জাপানের এই রূপান্তরের পেছনে আমেরিকানদের বিশাল অবদান। জাপানিদের আবেগের প্রতি বরাবরই সন্মান দেখিয়েছে আমেরিকানরা। যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজোর মৃত্যুদণ্ড হলেও সম্রাট হিরোহিতোকে স্পর্শ করেনি আমেরিকানরা। প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তুজো সহ যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভা সম্রাটের কমান্ড মেনেই যুদ্ধ পরিচালনা করার সত্যের বিপরীতে সম্রাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার শঙ্কায় জাপানিদের আবেগের প্রতি সন্মান দেখিয়ে সম্রাটকে নিয়ে টানাটানি থেকে বিরত থেকেছে আমেরিকানরা। আগের একটি লিখায় উল্লেখ করেছিলাম ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক আর শিক্ষা বিষয়ে বিশেষ মর্যাদা থাকার কারণে কিয়োতোতে আনবিক বোমা নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিল আমেরিকানরা। বিজয়ীর বেশে আমেরিকানরা জাপানে শাসন কাজ চালাতে গিয়ে পরাজিত জাপানিদের রীতিমত হাতে ধরে টেনে উঠিয়েছে। ভূমিসংস্কার যে কোন দেশের উন্নয়নে প্রধান নিয়ামক এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে এটি সবচেয়ে কঠিন কাজ। সামন্তবাদী জাপানি সমাজে যোদ্ধাগোষ্ঠী সামুরাই আর ধনী কৃষক/ভূস্বামীর মত কিছু সংখ্যক মানুষের হাতেই ভূমির মালিকানা ছিল আর সেই জায়গাতেই আমেরিকানরা সর্বপ্রথম হাত দেয়। ধনী কৃষক এবং ভূস্বামীরা তাদের স্বার্থেই মিলিটারিজমকে প্রশ্রয় দেয় যার ফলে রাষ্ট্র বৈদেশিক সম্পর্কে আধিপত্যবাদে উৎসাহিত হয় এরকম ভাবনা থেকে মার্কিন সেনা নেতৃত্ব জোরপূর্বক জাপানে ভূমিসংস্কারের কাজটি সেরে ফেলে। ফলে একধরণের সাম্যবাদী বিপ্লব ঘটে যায় জাপানি সমাজে। এই শাপেবরটি জাপানি সমাজ সংস্কারে বিশাল ভূমিকা রাখে। আমেরিকানরা হিটলারের যুদ্ধবাজ নেতৃত্ব সহ জার্মানির কাছ থেকে যে শিক্ষাটি নিয়েছিল সেটি হচ্ছে যোগাযোগ অবকাঠামো অর্থাৎ বিশাল বিশাল হাইওয়ে তৈরি করে পুরো দেশটাকে একসূত্রে গেঁথে ফেলা। নিজের দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো গঠনের এই মডেলটি আমেরিকানরা যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করে। এতে মার্কিনীদের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকলেও দিনশেষে জাপানের উন্নয়নের সুচককেই বেগবান করেছে। জাপানে মিলিটারিজমের বিলুপ্ত সাধনের পর প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতায় জাপানিদের মেধা মনন আর শ্রম বিনিয়োগে যে মৌলিক উত্তরণের সুচনা ঘটিয়েছিল আজকের জাপান সেই রূপান্তরেই ফলাফল।
শিনশু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময় থেকেই লং-ড্রাইভে নেশা থাকার কারণে জাপানের ৪৭টি প্রিফেকচার বা জেলার মধ্যে ৪৪টি ঘুরবার সুযোগ হয়েছে। সাত-আট হাজার ফুট উচু পাহাড় থেকে গহীন গ্রামাঞ্চল সর্বত্রই রাস্তার ছড়াছড়ি জাপানে। জনসংখ্যার ঘনত্বের ব্যবধান ছাড়া আনুপাতিক অর্থনৈতিক অবকাঠামো যথা দোকানপাট, শপিং মল এমনকি গাড়ীর শো-রুমে গ্রাম আর শহরের কোন পার্থক্য নেই। দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামীণ অর্থনীতিতে গোয়ালঘর বা হাঁসমুরগির খোঁয়াড়ের মত জাপানের গহীন গ্রামের বাড়ীগুলোতেও গোয়ালঘরের বদলে গ্যারেজ দেখতে পাবেন যা অর্থনীতির সাম্যতার বিস্ময়কর এক উদাহরণ। কে জিদোশা অর্থাৎ ১০০০ সিসির কম ক্ষমতা বিশিষ্ট ইঞ্জিনের হলুদ প্লেটের ছোট ছোট গাড়ী গ্রামের প্রায় সব বাড়ীতেই দেখতে পাবেন।
সেতো নাই কাই বা সেতো ইনল্যান্ড সাগর জাপানের প্রধান দ্বীপ হনশু থেকে অন্য তিনটি দ্বীপের সবচেয়ে ছোটটি সিকোকুকে আলাদা করেছে। সাগরটির নাম জাপানিতে সেতো; এই সেতো মানে আমাদের সেতু বা ব্রিজ নয়, বাংলায় আমরা যাকে সেতু বলি জাপানিতে সেটি হচ্ছে হাশি। অর্থাৎ সেতো ওহাশি বাংলায় বললে হবে সেতো সেতু। হাশির আগে ও অক্ষরটি এখানে সন্মানসুচক অর্থাৎ গ্রেট অর্থে ব্যবহৃত হয়। সেতো ব্রিজ জাপানের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম নান্দনিক অবকাঠামো।
আমার বোন থাকত শিকোকু দ্বীপের কাগাওয়া প্রিফেকচারের মারুগামে শহরে। ভগ্নিপতি ডঃ মাহতাব কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে মারুগামে শহরে একটি ফার্মা কোম্পানিতে প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করতেন। শিনশুর কৃষি অনুষদে তখন আমরা বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী ছাত্র ছিলাম। পাশের শহর কোমাগানেতে আজাদ ভাই শিক্ষকতা করতেন জেওসিভি (জাপান ওভারসিজকোঅপারেশন ভলান্টিয়ার্স)তে। জেওসিভি হচ্ছে জাপান সরকারের জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি) এর একটিপ্রতিষ্ঠান যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সেক্টরে উন্নয়ন সহায়তার জন্যে ভলান্টিয়ার্স পাঠায়। আজাদ ভাই আর আমার গাড়ী নিয়ে আজাদ ভাই, ভাবী, পার্থ আর আলম ভাইয়ের পরিবার নিয়ে হাজার কিলোমিটারের লং ড্রাইভে রওয়ানা দিলাম বোনের বাসার উদ্দেশ্যেশিকোকুর পথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থ আর আলম ভাই তখন জাপান শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা মনবুশো বৃত্তি নিয়ে শিনশু বিশ্ববিদ্যালয়েউচ্চ শিক্ষারত। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ ইয়াহিয়াও তখন মনবুশো বৃত্তি নিয়ে শিনশুতে অধ্যয়নরত।ওকিনাওয়া বাদে জাপানের মূল ভূখণ্ড চারটি বড় দ্বীপ নিয়ে গঠিত। হোক্কাইডো, হনশু, শিকোকু আর কিউশু এই চারটি দ্বীপের মধ্যে হনশু বৃহত্তম; জাপানের ৪৭ প্রিফেকচারের মধ্যে ৩৪টি নিয়ে হনশু গঠিত। প্রায় ৪০ লক্ষ জনসংখ্যার শিকোকুর রয়েছে চারটি প্রিফেকচার; কাগাওয়া, তকুশিমা, কচি আর ইহিমে। জাপান ইনল্যান্ড সাগর দ্বারা বিচ্ছিন্ন শিকোকুকে মূল দ্বীপ হনশুর সাথে সংযুক্ত করেছে একাধিক ব্রিজ যার মধ্যে সেতো ওহাশি অন্যতম। সেতো ওহাশি অনেকগুলো ডাবলডেকার বা দোতলা ব্রিজের সমন্বিত কাঠামো। হনশুর ওকাইয়ামা প্রিফেকচার আর শিকোকুর কাগাওয়া প্রিফেকচার মাঝে অবস্থিত সেতো ইনল্যান্ড সাগরের ৫টি ছোট দ্বীপের একের পর এক সংযোগ সাধন করেছে এই সেতো ক্লাস্টার ব্রিজ। বিশ্রাম নেবার জন্যে হাইওয়ে সার্ভিস এরিয়া বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। জাপানি সার্ভিস এরিয়া আমার কাছে মনে হয়েছে অপরূপ নান্দনিকতায় শোভিত। সার্ভিস এরিয়ার সংখ্যা আর গুনগতমানে জাপানের সমকক্ষ কোন দেশ এখন পর্যন্ত আমার চোখে পরেনি। সেতো ব্রিজের সার্ভিস এরিয়া সেতো ইনল্যান্ড সাগরের দ্বীপগুলোতে অবস্থিত। সেতো ব্রিজের মাঝামাঝিতে প্যাঁচানো রাস্তা বাঁক খেতে খেতে যেভাবে সাগরের মাঝে ছোট্ট দ্বীপের সার্ভিস এরিয়াতে মিশে যায় আবার প্যাঁচিয়ে বাঁকে বাঁকে উপরে উঠে ব্রিজের সাথে এসে মিলিত হয়, চাক্ষুষ দেখার নৈসর্গিক অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ছাত্র অবস্থায় তখন ব্যাচেলর জীবন। ব্যাচেলর জীবনে প্রথম গাড়ী মালিকানা; মডেলটি ছিল নিশান মার্চ। জাপানিজ ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত ইন্টারন্যাশনাল পারমিট দিয়ে গাড়ি চালিয়েছি। বাংলাদেশের ড্রাইভিং স্কুলগুলোর সহায়তায় প্রাপ্ত এই পারমিটগুলো জাপানি ট্রাফিক পুলিশ গ্রহণ করলেও এগুলোর বৈধতা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। যাক পরবর্তীতে কঠিন পরীক্ষা উত্তরণের মাধ্যমে জাপানি লাইসেন্স পেয়ে যাই। ঝকঝকে তকতকে ১০০০ সিসির নিশান মার্চে ১৪০ কিমি গতি তুলতে মনে হত গাড়ি উড়ছে। চ্যুও (সেন্ট্রাল), মেইশিন, সান-এই ইত্যাদি বিখ্যাত সব জাপানিজ হাইওয়ে ধরে অসংখ্য টানেল, পাহাড়, নদী আর নাগোয়া/কিয়োতো/ওসাকা/কোবের মত বিখ্যাত শহরগুলোর পাশ দিয়ে কখনো স্পীড লিমিট মেনে কখনো না মেনে একজন তরুণ ড্রাইভারের ড্রাইভ করার ভাললাগার অনুভূতি অন্য উচ্চতায় থাকাই তো স্বাভাবিক। তারপর সেতো ব্রিজের রূপে আপ্লুত হওয়াটাই আরো বড় ব্যাপার। রেল আর রোডের দোতলা এই ব্রিজটি তৈরি হওয়া চলে ১৯৭৮-৮৮ পর্যন্ত। প্রায় ১৩ কিলোমিটার লম্বা এই সেতুটি বিশ্বের দীর্ঘতম দোতলা ব্রিজ। উপর তলায় গাড়ি, নীচ তলায় রেল। গাড়ীতে বা ট্রেনে ব্রিজটি পার হতে মিনিট বিশেক লাগে। জাপানের অধিকাংশ এক্সপ্রেস হাইওয়ে টোল রোড অর্থাৎ পয়সা লাগে। ওকাইয়ামার কুরাশিকি থেকে কাগাওয়ার সাকাইদে পর্যন্ত টোল প্রায় চল্লিশ ডলার,পশ্চিমা দেশের তুলনায় বেশীই বটে। শিকোকু দ্বীপের ৪টি প্রিফেকচারের ৪-৫ মিলিয়ন মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সেতো ব্রিজ একটি মাইলস্টোন। প্রায় ৭ বিলিয়ন ইউএস ডলারে এই সেতু ১০ বছরের কর্মযজ্ঞের ফল। ব্রিজটি বানাতে গিয়ে মারা পড়েন ১৩ জন কর্মী এবং অবশেষে চালু হয় ১০ই এপ্রিল, ১৯৮৮ সালে। সানফ্রান্সিস্কোর গোল্ডেন গেট ব্রিজ, ইস্তাম্বুলের সুলতান মেহমেত ব্রিজ, ডেনমার্ক আর সুইডেনের ওরেসান্দ ব্রিজ হচ্ছে সেতো ব্রিজের এফিলিয়েটেড ব্রিজ বা সিস্টার ব্রিজ। পেশাগত জীবনের পথ পরিক্রমায় এই সবগুলো ব্রিজই দেখার সুযোগ হয়েছে; ইচ্ছে আছে এগুলো নিয়েও লিখবার।
আমাদের মূল গন্তব্য ছিল মারুগামে শহর। সেতো ব্রিজ পার হয়ে সাকাইদেতে এক্সপ্রেস হাইওয়ে থেকে বের হয়ে জাপানের আন্তঃশহর ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে মারুগামে পৌঁছা। আমার বোনের দুটো ছেলে রাশদী আর সুনান। রাশদী ৮ বছরের আর সুনান ২ বছরের। রাশদী এখন যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তার আর সুনান যুক্তরাষ্ট্রে তরুণ অর্থনীতিবিদ। মারুগামে শহররের পুরো ভ্রমণে এরা ছিল মূল আকর্ষণ। রাশদী মামার পিছে পিছে; খেলনার দোকানে নিয়ে গিয়ে মামা দামী খেলনা কিনে দিতে চাইলেও নিরিবিলি এই বাচ্চাটির দামীও চাইতে পছন্দ ছিল নিজের মত করে পছন্দের খেলনা। আর কোলে কোলে ঘুরে বেড়ানোর গোটটা-গাটটা সুনান যে কোন খেলনাতেই খুশী। সাকাইদেতে সেতো ব্রিজের নিচে একটি চমৎকার পার্ক, শিকোকুর নিউজিল্যান্ড মুরা বা গ্রাম, হিউগু প্রিফেকচারের কোবের সাথে আওয়াজিশিমার এবং শিকোকুর সংযোগ সেতু ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান দেখে আজাদ ভাই, ভাবী কয়েকদিন থেকে টোকিও ফিরে যান। আমি বেড়ানো অব্যাহত রাখি। আমাদের পারিবারিক ভ্রমণের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল শিকোকু দ্বীপের চারিদিকে ডঃ মাহতাবের ড্রাইভে চারটি প্রিফেকচার কাগাওয়া, তকুশিমা, কচি আর ইহিমেকে চক্কর দিয়ে মন্থন করা। একটানা ড্রাইভে কখনো কখনো রাত্রিযাপন করতে হয়েছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নিঝুম নিরিবিলি কোন এক নির্জন জায়গায়, ঘুমের আয়োজন গাড়ীর মধ্যেই। নিস্তব্দ রাতে জোনাকিরাই ছিল আমাদের সাথী। আমার বোন কিছুটা ভয় পেলেও, জননিরাপত্তায় বিশ্বের নির্ভেজাল নিরাপদ দেশ জাপানকে নিয়ে আমি আর ডঃ মাহতাবের মনে কোন সংশয় ছিলনা। জনব্যস্ততার শহর বা পাহাড়ের নির্জন প্রান্তর সবখানেই জাপান নিরাপদ দেশ। এই নিরাপত্তা বা আঞ্জেন জাপানিদের হৃদয়ের গভীরে লালিত গর্বও বটে। শিকোকুর দ্বীপের উত্তরে সেতো ইনল্যান্ড সাগর বা সেতো নাইকাই আর দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগরের অংশ। সাগর আর পাহাড়ের মিতালী দেখতে দেখতে শিকোকুর দ্বীপের চারিপাশে ড্রাইভ করা হয়ে গেল প্রায় কয়েকশ কিলোমিটার।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিল শারমিন খান। শারমিন আর আমি শুধু সহপাঠী নই, এমনকি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসেও একসাথে ছিলাম। জীবনের অনিশ্চিত গন্তব্যে অনেক সহপাঠীর সাথে দেখা হতে হলে অপেক্ষা যুগযুগের। কারো সাথে কখনই আর দেখা হয় না;অনেকেই অকালেই ঝরে পৌঁছে গেছে না ফেরার গন্তব্যে। সৌভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে গোলাকার এই ভুবনে শারমিনের সাথে আমার দেখা হয়েছে নানান দেশে নানান সময়ে। দর্শনে আর ব্যক্তিত্বে শারমিন বরাবরই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আকর্ষণীয় মুখ। এই মুখের প্রেমে মগ্ন হলেন আমাদের সিনিয়র শহীদ ভাই। শহীদ ভাই-শারমিন দম্পতি থাকতেন কাগাওয়াতে; মনবুশো স্কলারশীপে শহীদ ভাই তখন পিএইচডি করছেন। শহীদ ভাইয়ের দুটো পোস্টডকের সময় যথাক্রমে টোকিও সংলগ্ন চিবার বাসা, কিয়োশু দ্বীপের মিয়াজাকির বাসায় আমার যেমন যাওয়া হয়েছে তেমনি আমার কিয়োশু দ্বীপের ওইতা প্রিফেকচারের সাইকি শহরের বাসায় এবং কানাডার টরেন্টোর বাসায় শারমিনেদেরও আসা হয়েছে। শহীদ ভাই আর শারমিন এখন আরকানসাসে। কাগাওয়াতে আমার বোনের বাসায় গিয়ে দেখা হল শারমিন আর শহীদ ভাইয়ের সাথে। শহীদ ভাইকে সাথে নিয়ে, ভাগ্নে রাশদী সহ হিরোশিমা যাবার প্লান করলাম। এবার ট্রেনে করে সেতো ব্রিজ পার হয়ে গেলাম হিরোশিমায়। হিরোশিমায় যাওয়া হয়েছে অনেকবার। আমার বন্ধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রলিন হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সময় সপরিবারে যাওয়া হয়েছে একাধিকবার। শহীদ ভাইয়ের সাথে প্রথমবার আনবিক বোমায় বিধ্বস্ত এই নগরীর দর্শনের অভিজ্ঞতা ছিল অনেক উত্তেজনাপূর্ণ। পিস পার্ক, আনবিক আঘাতের ক্ষত নিয়ে দাড়িয়ে থাকা স্থাপনা, দুঃসহ স্মৃতির যাদুঘর দর্শন আমাদের ভাবনাগুলোকে দাড় করিয়েছিল মানব সভ্যতার এক ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখি।
নিহন সাঙ্কেই অর্থাৎ জাপানিদের কাছে প্রকৃতির তিনটি বিস্ময়কর স্বর্গীয় উপহার হচ্ছে হিরোশিমার মিয়াজীমা দ্বীপ, মিয়াগী প্রিফেকচারের মাতসুসীমা আর কিয়োতোর আমানোহাশিদাতে। হিরোশিমা থেকে ফেরীতে করে যেতে হয় বিশ্ব হেরিটেজ সাইট জাপান ইনল্যান্ড সাগরের মিয়াজীমা দ্বীপে। জাপানিদের বিশ্বাস মিয়াজীমা দ্বীপে প্রকৃতি আর ঈশ্বর মিলেমিশে একাকার। শহীদ ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম মিয়াজীমা দ্বীপ ভ্রমণ। পরবর্তীতে একাধিকবার যাওয়া হয়েছে মিয়াজীমা দ্বীপে। মিয়াজীমা দ্বীপ আর হিরোশিমা নিয়ে বিস্তারিত লিখার ইচ্ছে রইল।