ড. সেলিম জাহান : ব্যস্ততা ছিলো, তাই প্রায় হুড়মুড় করে সামনেই যে হলুদ ট্যাক্সিটি খালি পেলাম তাতেই উঠে বসলাম। তাড়াহুড়োয় না আমি দেখলাম চালকের মুখ, না তিনি দেখতে পেলেন আমাকে। গাড়িতে উঠে আমার গন্তব্যের কথা বলেই হাতের এক তাড়া কাগজের পাতা উল্টাতে লাগলাম। পড়তে পড়তে বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম... খেয়াল করিনি কিছুই। হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠলাম। মুঠোফোনে কথা বলছেন ট্যাক্সিচালক এবং পরিষ্কার আঞ্চলিক বাংলায়। নিউইয়র্কে পথে-ঘাটে, অফিস- রেস্তোরাঁ কিংবা ট্যাক্সি-বাসে আজকাল বাংলা শোনাটা নতুন কিছু নয়।
প্রারম্ভিক কথাবার্তাতেই বোঝা গেলো যে, ভদ্রলোক দেশে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছেন। ধরা যাক, চালক ভদ্রলোকের নাম আবদুর রহমান। না অন্য কোনো কারণে নয়, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশে’র কথা মনে হলো বলেই ওই নামটি বললাম। বেশ জোরেই কথাবার্তা হচ্ছে এবং আমি এ প্রান্তে বসে ও প্রান্ত থেকে আবদুর রহমান সাহেবের স্ত্রীর কথাও শুনতে পাচ্ছিলাম। বোঝা গেলো তাদের নতুন বিয়ে হয়েছে, স্ত্রীটি থাকেন শ্বশুরবাড়িতে একগাদা দেবর-ননদ পরিবৃত হয়ে। প্রথমে মন দিইনি, তবে আমার কান খাড়া হয়ে উঠলো আলাপের বিষয়বস্তু শুনে। একপর্যায়ে কথোপকথনটি এ রকম মোড় নিলো।
শোনো, ঈদে তুমি সালোয়ার-কামিজ বানাইবা নিশ্চয়। ‘হ কাদের দর্জিরে দিয়া বানামু’। ‘না, কাদেরের কাছে যাইও না, ও ব্যাডার বয়স কম। রকিব মিয়ার কাছে কাপড় দিয়ো। ওই বুড়া রকিব দর্জি কোনো ডিজাইনই জানে না’। ‘আমি কাদের দর্জিরে দিয়া বানামু... তিনডা সালোয়ার কামিজের সেট’। ‘হ কাদেররিয়ারে দিয়া তো বানাইবাই। গা না দেহাইলে তো ভাত হজম হইবে না’। ‘কী কইলা! আইজ কাইল তুমি বড় বেশি গলা কাডা জামা পর। বেশি টাইট সব সালোয়ার-কামিজ। বেবাক কিছু দ্যাহা যায়’। ‘(রাগতস্বরে) আমি গলা কাডা জামা পরি! বেশি টাইট পরি! কেডা কইছে তোমারে? আমি আগে যে ডিজাইনে পরতাম, সে রহমই পরি। না ওই রহম পরতে পারবা না। ঘরের মধ্যে পাঁচ-দশডা পুরুষ মানু, হে গো সামনে গা খালি জামা পইরা ঘুরতে খুব ভালো লাগে না’? ‘(বিস্মিত স্বরে) হ্যারা তোমার ছোড ভাই... আমার ছোড ভাইয়ের মতো। (যুক্তিতে সুবিধে না করতে পেরে), হোন হোন, টাইট জামা সইলের জন্য ভালা না। শ্বাসে কষ্ট হইবো’। ‘আমারডা আমি বুঝবো। না তুমি বেলেল্লাপনা করতে পারবা না। আমি যা পরি, হে রহমই পরবো। কি করবা তুমি? কি করতে পারো’? ‘(একটু চিবিয় হাসির শব্দ) আমি? কি করতে পারি? দেখবা? সামনের মাস থনে ট্যাকা পাইবা না’। ‘এতো বড় একটা কথা কইলা তুমি আমারে (কথা কান্নায় জড়িয়ে আসে)’।
মুঠোফোন কেটে দেয়ার শব্দ পাই। বেশ আরাম করে নড়েচড়ে বসলেন আবদুর রহমান সাহেব। তার মুখ দেখতে পাই না, কিন্তু টের পাই আবদুর রহমান সাহেব বেশ আত্মতৃপ্তিতে শিস দিচ্ছেন... ভাবখানা ‘আটকানো গেছে মেয়ে মানুষটাকে’। পেছন থেকে দেখি, বেশ হৃষ্টচিত্তে বাইরেটা দেখছেন আবদুর রহমান সাহেব। গ্রীষ্মের চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বলএকটা দিন আজকে। বেশ গরম। এতো সুন্দর আবহাওয়ায় সবাই বাইরে। মেয়েদের গায়ে গ্রীষ্মের রঙিন পোশাক... বেশ কিছুটা সংক্ষিপ্ত, বাহু-গলা অনাবৃত। তাকিয়ে দেখি, আবদুর রহমান সাহেব বেশ তারিয়ে তারিয়ে সে সব উপভোগ করছেন। তার দৃষ্টি রাস্তায় চলমান নারীদেহের প্রতি। তার চোখ লেহন করে চলেছে ওইসব নারীদের অনাবৃত গলা আর বাহু। আবদুর রহমান সাহেবের তাতে কোনো দ্বিধা, কোনো সংকোচ, কোনো অস্বস্তি নেই। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :