পুলক ঘটক : ব্যক্তির পরিচয় নির্ধারণে বাবার নামের সঙ্গে মায়ের নামও সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক করার জন্য হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন হয়েছে। প্রাথমিক শুনানির পর আদালত রুল দিয়েছেন। আমার মতে, বাবার নাম যুক্ত করা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত নয়। শুধুমাত্র মায়ের নাম দেওয়া বাধ্যতামূলক হওয়া দরকার। বাবার নাম দেওয়া বা না দেওয়ার ব্যাপারটি হবে ইচ্ছাধীন। কারণ অনেক সন্তান আছে, যারা বাবার নাম কি জানেন না। বাবা কেবলমাত্র জন্মদানের জৈবিক প্রক্রিয়া সম্পাদন করে পালিয়েছেন। মা সারাজীবন ধুকে ধুকে সেই সন্তানকে মানুষ করেছেন। ধর্ষণের শিকার নারী মা হলে সেই সন্তানকে নিজের পরিচয় নির্ধারণের জন্য সেই ধর্ষক পিতার পরিচয় ব্যবহার করতেই হবে, এ কেমন বিধান? শুধু মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকার নাগরিকদের দেওয়া উচিত।
প্রেমের ছলনায় ভুলিয়ে কিংবা বিবাহের অঙ্গীকার করে একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করার পর সন্তানসম্ভবা মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না -এরকম দৃষ্টান্ত আমি দেখেছি। এই অবস্থায় মায়ের পেটেই সন্তানকে হত্যা করার মতো অমানবিক পরিস্থিতি হতে দেখেছি। কোনো সাহসী মা যদি তার পেটের সন্তানকে হত্যা না করে তাকে তার নিজ পরিচয়ে মানুষ করতে চায়, তাহলে কেন সে অধিকার পাবে না? আমি একসময় দৌলতদিয়া যৌনপল্লির শিশুদের নিয়ে রিপোর্ট করেছিলাম। সরেজমিনে ঐ বাচ্চাগুলোর অবস্থা দেখেছি। বড়ই দুঃখজনক তাদের জীবন। অথচ ঐ শিশুগুলো তাদের জন্মের জন্য নিজেরা দায়ী নয়। স্কুলে ভর্তি হওয়া এবং চাকরিসহ জীবনের সবক্ষেত্রে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতে হয়। সমাজে ও রাষ্ট্রীয় কাজে টিকে থাকার জন্য কাউকে মিথ্যা বাবা সাজিয়ে তাদেরকে চলতে হয়। এনজিওদের স্কুলে পড়াশুনা করা একটি মেধাবী মেয়ে বিদেশি স্কলারশিপ পেলেও বাবার পরিচয় দিতে না পারায় সে পাসপোর্ট করতে পারেনি। ক্যানসার রোগে আক্রান্ত একটি মেয়েকে দেখেছি।
চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া তার জরুরি ছিলো। কিন্তু বাবার পরিচয় দিতে না পারায় রাষ্ট্র তাকে পাসপোর্ট দিচ্ছিল না। এটা কোনো মানবিক রাষ্ট্র হতে পারে না। সন্তানের পরিচয় নির্ধারণে মায়ের পরিচয়টাই আসল পরিচয়। জৈবিক বাবার পরিচয় প্রমাণ সাপেক্ষ। আমি রিট আবেদনকারিকে অনুরোধ করবো, ব্যক্তির পরিচয় নির্ধারণে বাবার নাম দেওয়া বাধ্যতামূলক না করার জন্য আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করতে। অথবা কোনো মানবাধিকার সংগঠন এই মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করতে পারে। অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে আমার আবেদন, রাষ্ট্রের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করার সময় বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার জন্য। আরও একটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে। তা হলো, হারিয়ে যাওয়া শিশুদের অবস্থা কি হবে? পথশিশু -যারা বাবা-মা কারও নাম জানে না- তাদের কি হবে? রাষ্ট্র তাদের নাগরিক অধিকার দেবে না? শৈশবে হারিয়ে যাওয়া, পিতৃমাতৃহীন ও বংশ পরিচয়হীন শিশুরা যেন নিজ পরিচয়ে, রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা কোনো সংগঠনের পরিচয়ে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।