প্রান্তিকতা মানেই জটিলতা। জটিলতা মানেই ব্যাধি। মহাম্মন্যতা যেমন ব্যাধি তেমনি হীনম্মন্যতাও ব্যাধি। ভীতম্মন্যতা যেমন ব্যাধি, হঠকারিতাও তেমন ব্যাধি। কৃপণতা যেমন ব্যাধি, অপব্যয়ও তেমন ব্যাধি। ‘আমি কিছু জানি না, আমি হীন, আমি অযোগ্য, আমার বিদ্যা নেই, বুদ্ধি নেই, শক্তি নেই’- এরকমটি ভাবা যেমন ক্ষতিকর তেমনি ‘আমি সব জানি, আমি মহান, আমি শ্রেষ্ঠ’- এ রকম ভাবাও ক্ষতিকর। যে সর্বদা নিজেকে বড় মনে করে সে কারো কাছ থেকেই কিছু শিখতে পারে না। আত্মম্ভরী ব্যক্তি সমর্পণ জানে না। যে সমর্পণ জানে না সে বঞ্চিত থাকে প্রেমের স্বাদ থেকে। ‘আমি অনেক বড়’ ভাবতে ভাবতে তার বেলুনটিই ফেটে যায়।
প্রান্তিকতা দুঃখ উৎপাদক। সুখ মাঝখানে। অথচ মন প্রান্তিকতার দিকেই ঝুঁকে পড়ে। মানুষ সুখ চায়, কিন্তু সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। মন মাঝখানে স্থির থাকতে পারে না। মন দোলকের মতো- একবার বাম প্রান্তে আরেকবার ডান প্রান্তে দোলতে থাকে। মন বলে- ‘হয় সারাদিন খাও, না হয় অনাহারে থাক; হয় প্রবৃত্তি মার্গে চল, না হয় নিবৃত্তি মার্গে’। মাঝখানে থাকতে মজা লাগে না।
প্রান্তিকতা মানেই হলো স্বাভাবিক জীবনধারা থেকে বিচ্যুতি। বিচ্যুত হয়ে মজা পাওয়া একধরনের অসুস্থতা। রাজনীতিতে প্রান্তিকতা হলো কট্টর বাম ও কট্টর ডান। ধর্মে প্রান্তিকতা হলো জঙ্গিবাদ ও অত্যুগ্র কৃচ্ছ্রতা। ভোজনে প্রান্তিকতা হলো অত্যাহার ও অত্যল্পাহার। প্রত্যেক প্রান্তিকতাই অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক। যে দ্রুত অগ্রসর হতে চায় তার জন্য প্রান্ত থেকে নিরাপদ দূরে থাকা অপরিহার্য।
প্রান্তিকদের মূল সমস্যা হলো অপর প্রান্তে যারা আছে তাদের প্রতি অসহনশীলতা। তারা নিজের কথা ততোটা বলে না, যতোটা অপর প্রান্তের ভুল ধরে। নিজ প্রান্তের নির্ভুলতা সম্বন্ধে তারা নিশ্চিত না হলেও অন্য প্রান্তের ভুলতা সম্বন্ধে পুরোপুরি নিশ্চিত। তাই প্রান্তিকরা চরম অসহিষ্ণু হয়- দুই প্রান্ত থেকেই অবিরাম কাদা ছোড়াছুড়ি চলে।
অধুনা সুফিবাদেও ঢুকে গেছে প্রান্তিকতা। প্রতিটি সুফিবাদী গোত্র অন্য গোত্রের নিন্দায় ব্যস্ত। কয়েকটি গোত্র উদ্ধত আক্রমণাত্মক। কোনো কোনো গোত্র জীবনকে ভালোবাসার বদলে জীবনের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার তালিম দেয়। হত্যা, যদি তা আত্মহত্যাও হয় হিংসাত্মক। কারো ক্ষতি করা যেমন মন্দ, নিজের ক্ষতি করাও তেমন মন্দ। তাই প্রান্তিকতাকে মতাদর্শ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই- এটি হলো আবেগীয় অসুস্থতা। জঙ্গিবাদ যেমন মানসিক অসুস্থতা তেমনি নিজে নির্যাতন ভোগ করাও মানসিক অসুস্থতা।
ধর্ম হলো সৎ জীবনযাপন, সত্য জীবনযাপন। মানুষ ধর্ম বুঝে, কিন্তু ধর্ম পথে চলতে মজা লাগে না। শুধু মজার জন্য কিছু লোক সহজ-সরল পথ রেখে প্রান্তিক আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সিদ্ধি লাভের সংক্ষিপ্ত পথের সন্ধানে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় তাদের মন। প্রান্তিকতা দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে; ফলে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য মনে থাকে। প্রান্তিকতা থেকে উৎপন্ন হয় ক্রোধ; ক্রোধ থেকে সংঘাত। তাই প্রান্তিকতা ধর্মের দুশমন।
সত্য বলা, সৎ জীবনযাপন করা, সৎ জীবিকা অর্জন করা, পরিমিত আহার, পরিমিত নিদ্রা যাদের কাছে খুব কঠিন মনে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাই ঝুঁকে পড়ে প্রান্তিকতার দিকে। ধর্মের খোলসে যেখানে যেখানে যে-সব প্রান্তিকতা চলছে তা শুধু অর্থহীন নয়- অনর্থ উৎপাদক। ফেসবুক থেকে