ডা. মো. তাজুল ইসলাম : ‘মানুষ সঠিকভাবে দেখতে পারে শুধু হৃদয় দিয়ে। যা কিছু অত্যাবশ্যকীয় তা তা চর্ম চোখে অদৃশ্য থাকে’ antoine De Saint Exuopre. আমাদের বিবর্তনের আবেগীয় ইতিহাস হচ্ছে ‘ভয়’। এই ভয়ের কারণে আমরা পরিবারকে ও নিজকে বিপদ থেকে রক্ষার জন্যশক্তি সামর্থ্য জড়ো করি। বিপদের সময় তাৎক্ষণিকভাবে স্বত:স্ফূর্তভাবে সাড়া দেওয়ার প্রবণতা, আমাদের স্নায়ু সিস্টেমে গ্রোথিত রয়েছে। আদিমকালে মানব পূর্ব পুরুষরা এমন ক্রান্তিকাল কাটিয়েছে, যখন তারা শুধু ‘অস্তিত্ব ও মৃত্যুর’ পার্থক্য বুঝতো। একই সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে ভাবতো যারা তাদের বংশধারা অব্যাহত রাখবে। এসব কারণে যখন নিজের বা পরিবারের কারো অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হতো, তারা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া করতো নিজেদের রক্ষা করার জন্য। এই আদিম প্রবৃত্তি এখনো আমাদের স্বভাবে দৃঢ়মূল হয়ে রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সমাজ সভ্যতার এতো অগ্রগতি হয়েছে যে পুরনো বিবর্তনের গতি তাকে ধরতে পারছে না।
আমরা বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে যতো অগ্রসর হচ্ছি সাংস্কৃতিক, মানবিক দিক থেকে তত অগ্রগতি হয়নি। কিছু কিছু সামাজিক নিরোধমূলক নৈতিকতা সমাজ গ্রহণ করেছে বটে, তবে তা আমাদের মূল প্রবৃত্তি দমনে তেমন কার্যকর নয়। আমরা এখনো আবেগীয় প্রতিক্রিয়া করি হাজার হাজার বছর আগেকার প্রকৃতি অনুযায়ী, আধুনিক সভ্যতায় যেমন হওয়া উচিত ছিল তেমনভাবে নয়। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড তার ‘Civili“ation and ItÕs discontents’ বইতে উল্লেখ করেন, সমাজকে বাহির থেকে ‘রীতি -আইন – কানুন’ প্রয়োগ করতে হয়েছে যাতে মানুষ তার অতিরিক্ত আবেগের ঢেউকে সামলে রাখতে পারে। এরকম ‘সামাজিক নিরোধ’ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও প্রায়ই যুক্তির চেয়ে তীব্র আবেগ/প্রেষণা আমাদের প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। মানুষ কেন এরকম প্রকৃতির হলো? কারণ মানুষের ‘মানসিক জগতের আর্কিটেকচার বা স্থাপত্য নকশা’। এগুলো হচ্ছে আমাদের আবেগের ‘বেসিক নিউরাল সার্কিট্রি’।
আমরা জন্মগ্রহণ করি সেই সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যেগুলো ৫০ হাজার প্রজন্মের আগে মানুষের জন্য সর্বোত্তম ছিল। তখন পশুর সঙ্গে পাশবিক আচরণ করেই মানুষকে টিকে থাকতে হতো। অথচ আমরা ভাবি আমরা জন্মগ্রহণ করি গত কয়েক প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য নিয়ে। মানুষের আবেগীয়, সাংস্কৃতিক ও মানবিক বিবর্তনের হার হচ্ছে খুবই শ্লথ গতিতে, কিন্তু আমাদের বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশ হচ্ছে তার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি হারে।
গত ১০ হাজার বছরে মানব সভ্যতার দূরত্ব অগ্রগতি হয়েছে এবং জনসংখ্যা ও বিপুল হারে বেড়েছে (৫০ লাখ থেকে ৭০০ কোটি) । কিন্তু এসব অগ্রগতির খুব কমই ‘দাগ’ পড়েছে আমাদের জৈবিক কাঠামোতে ও আবেগীয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে। তাই বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই এটা ভেবে যে, মানুষ এখনো কেন এতো নিষ্ঠুর, নির্মম, অমানবিক ও পাশবিক আচরণ করে। আমরা বিবর্তিত হচ্ছি খুবই ধীর গতিতে, যে গতি বাড়াতে পারতো সমাজ, রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকেরা।
মানবিক, সংস্কৃতিবান, হৃদয়বান ও সৃজনশীল মানুষ যদি সমাজ, প্রশাসনের সর্বস্তরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পারতো, তাহলে এই ‘মানবিক বিবর্তন’ আরও জোরদার গতিতে হতে পারতো। কবে পাবো সেই সমাজ, কবে তৈরি হবে সে মানবিক জৈবিক কাঠামো?
লেখক : অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট