সাঈদা মুনীর: কবি বেলালকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
কবি বেলালের সাথে কাটানো কিছু সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি শেয়ার করে তিনি নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে লিখেছেন, ‘এখন কৃষ্ণচূড়ার কাল। এ রকম এক কৃষ্ণচূড়ার দিনেই বেলাল ভাইয়ের সাথে আমার আলাপ। পরিষ্কার মনে পড়তেছে, স্মৃতি উগড়ে দিতেছে একের পর এক সব ঘটনা।’
কবি বেলাল‘তপ্ত রোদে ভিজে ভিজে আমরা হাঁটতেছিলাম ধানমন্ডির নানা রাস্তায়। আমাদের সাথে ছিলো ফরাসী রাগী যুবক গদার, ত্রুফো আর রুশ মিস্টিক তারকোভস্কি। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় টের পাইলাম ক্ষুধায় মাথা ঘুরতেছে। যে কোনো মুহূর্তে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারি।’
‘বেলাল ভাই টেলিপ্যাথিক গুণে সেটা বুঝে গেলেন। অথবা তাঁরও মাথা ঘুরবার উপক্রম হইছিলো ক্ষুধায়। আমাকে নিয়ে পাশের একটা আবাসিক বাড়ীর নীচতলার রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লেন। তারপর সেই এক রাজকীয় ভোজ। খেতে খেতে ভুলেই গেলাম আমরা কি নিয়ে কথা বলতেছিলাম। দুই ভেতো বাঙালী তখন জ্ঞান সাধনা ছেড়ে বাঙালির আদি সাধনা ভাত-সাধনায় মজে গেলাম।’
‘খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা আবার হাঁটতেছি। বেলাল ভাইকে তাঁর অফিসে ছেড়ে শাহবাগ চলে যাবো। তারপর বহু দুপুরে এরকম হাঁটা, কথা, আর খাওয়া চলেছে রুটিন মতো। তবে শেষ দিকে এসে একটা নতুন জিনিস যোগ হয়েছিলো। বিদায়ের আগ মুহূর্তে হাত মেলানোর উসিলায় আমার হাতে পাঁচশো টাকা গুঁজে দিতেন। আমার তো অভাব। আমি তো টাকা নিবোই। কিন্তু তবুও এক ধরনের লজ্জা এসে জড়াইয়া ধরতো।’
‘তখনকার অভাবী সেই দিনে সেই পাঁচশো টাকা ছিলো অমূল্য। কিন্তু আমি কি কেবল এই পাঁচশো টাকা আর দুপুরের রাজভোগই পেতাম তার কাছে? সবচাইতে জরুরী যে জিনিসটা তার কাছে পেতাম সেটা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস।’
‘‘বাংলাদেশের প্রচলিত কালচার হচ্ছে ‘চাকা পাংচার কালচার’! তরুনেরা স্বপ্ন নিয়ে সিনিয়রদের কাছে যাবেন। আর সিনিয়ররা পরম মমতায় তাদের স্বপ্নের চাকা পাংচার করে দিবেন।বেলাল ভাই ছিলেন উল্টো স্বভাবের মানুষ।’’
‘আমি কোনোদিন ফিল্ম স্কুলে যাই নাই, কাউকে অ্যাসিস্ট করি নাই। আমার স্কুল ছিলো বেলাল ভাইয়ের আড্ডা আর শাহবাগ। প্রতিদিন একটা করে ছোট ছবির স্ক্রিপ্ট লিখে তাঁকে পড়ে শোনাতাম। আর উনি শুনে বলতেন, ‘সরয়ার, তুমি তো সাংঘাতিক লিখছো। তুমি জানো তুমি কি লিখছো?’ তারপর শুরু করতেন ব্যাখ্যা। সেই ব্যাখ্যায় বার্গম্যান থেকে কমলকুমার হয়ে কখনো কখনো ছফা ভাইও চলে আসতেন।’’
‘এখন পিছনে তাকাইয়া মনে হয়, আসলে আমি এমন বিশেষ ভালো কিছু বোধ হয় লিখি নাই। কিন্তু উনি প্রশংসা করতে করতে আমার জন্য বারটা এতো উঁচু করে ফেলেছেন যে আমাকে চেষ্টা করতে হয়েছে সেই বারের উচ্চতা ছোঁয়ার, লাফাতে হয়েছে/হচ্ছে ক্রমাগত।’
‘এ করতে করতেই হয়তো অল্প অল্প করে শিখছি, শেখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মানুষের জীবনে এই বিশ্বাসটা পুঁতে দেয়ার লোক খুব দরকার। তাহলেই না একসময় সেই ছোট্ট বিশ্বাসের বীজ বড় হয়ে ফুল দেবে, দেবে ফল।
প্রসঙ্গত, একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি বেলাল চৌধুরীর মৃত্যুতে গোটা দেশে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে তাকে স্মরণ করছেন। ’- অনলাইন
আপনার মতামত লিখুন :